-64ea2def07e43.jpg)
Ramprasad Sen
Poet
Date of Birth | : | 17 July, 1723 |
Date of Death | : | 10 May, 1775 (Aged 51) |
Place of Birth | : | Garalgacha, India |
Profession | : | Poet |
Nationality | : | Indian |
কবিরঞ্জন" রামপ্রসাদ সেন (Ramprasad Sen) ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর এক বিশিষ্ট বাঙালি শাক্ত কবি ও সাধক। বাংলা ভাষায় দেবী কালীর উদ্দেশ্যে ভক্তিগীতি রচনার জন্য তিনি সমধিক পরিচিত; তার রচিত "রামপ্রসাদী" গানগুলি আজও সমান জনপ্রিয়। রামপ্রসাদের জীবন সংক্রান্ত নানা বাস্তব ও অলৌকিক কিংবদন্তি বাংলার ঘরে ঘরে প্রবাদবাক্যের মতো প্রচারিত। তবে নানা সূত্র থেকে তার জীবন সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক তথ্যও পাওয়া যায়।
রামপ্রসাদ সেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের এক তান্ত্রিক বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে। বাল্যকাল থেকেই কাব্যরচনার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ লক্ষিত হত। পরবর্তীকালে তিনি তন্ত্রাচার্য ও যোগী কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার রচিত ভক্তিগীতিগুলি তার জীবদ্দশাতেই বিপুল জনপ্রিয়তা লাভে সমর্থ হয়। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত ধারা বাউল ও বৈষ্ণব কীর্তনের সুরের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগরাগিণীর মিশ্রণে তিনি বাংলা সংগীতে এক নতুন সুরের সৃষ্টি করেন। রামপ্রসাদী সুর নামে প্রচলিত এই সুরে পরবর্তীকালেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম সহ বহু সংগীতকার গীতিরচনা করেছেন।
জীবনী
বিভিন্ন সূত্র থেকে রামপ্রসাদ সেনের যে জীবনকথা সংগৃহীত হয়েছে, তার একটি বড়ো অংশই হল লোকমুখে প্রচারিত কিংবদন্তি। যদিও এর সঙ্গে নানা ঐতিহাসিক বাস্তব তথ্যেরও সংমিশ্রণ ঘটেছে।
প্রথম জীবন
কলকাতা শহরের ২৫ মাইল উত্তরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত হালিশহর গ্রামে (বর্তমানে শহর) এক তান্ত্রিক বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে রামপ্রসাদ সেনের জন্ম। তার জন্মের প্রকৃত তারিখটি জানা যায় না। তবে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে অনুমিত হয় যে, তার জন্ম হয়েছিল ১৭১৮ অথবা ১৭২৩ সালে। রামপ্রসাদের পিতা রামরাম সেন ছিলেন একজন আয়ুর্বৈদিক চিকিৎসক ও সংস্কৃত পণ্ডিত। রামপ্রসাদের মা সিদ্ধেশ্বরী দেবী ছিলেন রামরাম সেনের দ্বিতীয়া পত্নী। সেকালের রীতি অনুযায়ী, বাল্যকালে রামপ্রসাদকে একটি সংস্কৃত টোলে শিক্ষালাভের জন্য প্রেরণ করা হয়। সেখানে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ, সাহিত্য, ফার্সি ও হিন্দি ভাষা শিক্ষা করেন। ছেলেবেলা থেকেই কাব্যরচনা ও নতুন নতুন ভাষাশিক্ষায় তার আগ্রহ ছিল প্রবল।
রামরাম সেন চেয়েছিলেন যে, তার পুত্রও পারিবারিক চিকিৎসক বৃত্তি গ্রহণ করুক। কিন্তু রামপ্রসাদের সেদিকে আগ্রহ ছিল না। বরং আধ্যাত্মিক জীবনযাপনেই তিনি অধিকতর সুখী ছিলেন। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে তার পরিবারবর্গ সর্বাণী নামে এক বালিকার সঙ্গে বাইশ বছর বয়সী রামপ্রসাদের বিবাহ দেন। বিবাহের পর পারিবারিক প্রথানুযায়ী নবদম্পতি কুলগুরু মাধবাচার্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। কথিত আছে, দীক্ষাগ্রহণকালে গুরু তার কানে মন্ত্রপ্রদান করলে তিনি দেবী কালীর অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এক বছর পর তার গুরুর মৃত্যু হয়। এরপর রামপ্রসাদ তান্ত্রিক যোগী ও পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন বঙ্গদেশে কালী আরাধনার প্রবর্তক এবং সুপ্রসিদ্ধ শাক্ত তন্ত্রগ্রন্থ তন্ত্রসারের রচয়িতা। আগমবাগীশ রামপ্রসাদকে তন্ত্রসাধনা ও কালীপূজার পদ্ধতি শিক্ষা দেন।
চাকুরিবৃত্তি
রামপ্রসাদের পিতামাতা তাকে উপার্জনক্ষম করে তুলতে চাইলেও, রামপ্রসাদ অধিকাংশ সময়ই সাধনায় অতিবাহিত করতেন। এমতাবস্থায় রামরাম সেনের মৃত্যু হলে দারিদ্র্যের বশবর্তী হয়ে রামপ্রসাদকে বিষয়কর্মে প্রবৃত্ত হতে হয়। কলকাতায় এসে দুর্গাচরণ মিত্র নামে এক ধনীর কাছারিতে মাসিক ত্রিশ টাকা বেতনে কেরানির কাজ শুরু করেন তিনি। কথিত আছে, কাছারির হিসাবের খাতায় সদ্যরচিত শ্যামাসঙ্গীত লিখতে শুরু করলে, অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের মালিকের নিকট রামপ্রসাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানান। কিন্তু দুর্গাচরণ মিত্র গানগুলি পড়ে রামপ্রসাদের কবিত্বশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি কবিকে কেরানির কাজ থেকে অব্যহতি দিয়ে স্বগ্রামে প্রেরণ করেন এবং তার মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করেন।
সাধনা ও কাব্যরচনা
গ্রামে ফিরে রামপ্রসাদ কঠোর সাধনায় মগ্ন হন। জানা যায়, এই সময় তিনি আকণ্ঠ গঙ্গাজলে নিমজ্জিত অবস্থায় শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন। তান্ত্রিক প্রথা অনুযায়ী, তন্ত্রসাধনার আদর্শ পবিত্র এক পঞ্চবটীর (বট, বেল, আমলকি, অশোক ও অশ্বত্থ গাছের সম্মিলিত রূপ) তলায় পঞ্চমুণ্ডীর আসনে (সাপ, ব্যাঙ, খরগোশ, শৃগাল ও মানুষের করোটীর দ্বারা সৃষ্ট আসন) বসে তিনি ধ্যান ও সাধনা করতেন। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী কালী আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে তাকে দর্শন দিয়েছিলেন।
নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় রামপ্রসাদের গান শুনে মুগ্ধ হন। তিনি নিজেও ছিলেন কালীভক্ত। তাই রামপ্রসাদকে তিনি সভাকবির মর্যাদা দেন। রামপ্রসাদ অবশ্য মহারাজের রাজসভায় বিশেষ আসতেন না। তিনি তন্ত্রসাধনা ও কালীপূজাতেই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাকে ১০০ একর (০.৪০ বর্গকিলোমিটার, ০.১৬ বর্গমাইল) নিষ্কর জমি প্রদান করেন। এর প্রতিদানে রামপ্রসাদ তার বিদ্যাসুন্দর কাব্য কৃষ্ণচন্দ্রকে উৎসর্গ করেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে কবিরঞ্জন উপাধিও প্রদান করেছিলেন। মহারাজের অন্তিম সময়ে রামপ্রসাদ তার পাশে থেকে তাকে কালীর নামগান শুনিয়েছিলেন। শোনা যায়, নবাব সিরাজদ্দৌলা ও সুফি সন্তেরাও রামপ্রসাদের আধ্যাত্মিক সংগীতে মুগ্ধ হন। নবাবের অনুরোধে রামপ্রসাদ একবার তার সভাতেও গিয়েছিলেন বলে কথিত আছে।
মৃত্যু
বৃদ্ধ বয়সে রামপ্রসাদের দেখাশোনা করতেন তার পুত্র রামদুলাল ও পুত্রবধূ ভগবতী। রামপ্রসাদের মৃত্যু নিয়ে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। রামপ্রসাদ প্রতি বছর দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজা করতেন। একবার সারারাত পূজা ও গানের পর সকালে কালীপ্রতিমা মাথায় করে নিয়ে বিসর্জনের পথে বের হন রামপ্রসাদ। ভক্তগণ তার পিছন পিছন বিসর্জন শোভাযাত্রায় অংশ নেন। স্বরচিত শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে গঙ্গার জলে প্রতিমা বিসর্জনার্থে অবগাহন করেন রামপ্রসাদ। প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রাণ বহির্গত হয়। মনে করা হয়, এটি ১৭৭৫ সালের ঘটনা।
Quotes
Total 17 Quotes
ডুব দে মন ‘কালী’ বোলে, হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে। রত্নাকর নয় শূন্য কখনো। দু-চার ডুবে ধন না পেলে, তুমি দম-সামর্থ্যে এক ডুবে যাও, কুল-কুণ্ডলিনীর কূলে। জ্ঞান-সমুদ্রের মাজে রে মন, শক্তিরূপা মুক্তা ফলে।
ভেবে দেখো মন, কেউ কারো নয়। মিছে ফেরো ভূমন্ডলে। দিন দু-দিনের জন্য ভবে, ‘কর্তা’ বোলে সবাই বলে। আবার সে ‘কর্তারে দেবে ফেলে। কালা কালের কর্তা এলে। যার জন্য মরো ভেবে, সে কি সঙ্গে যাবে চলে?
অপার সংসার, নাহি পারাপার, ভরসা শ্রীপদ, সঙ্গের সম্পদ, বিপদে তারিণী করোগো নিস্তার। এ ভব বন্ধন করো বিমোচন, মা বিনে তারিণী কারে দিব ভার।
জ্ঞানাগ্নি জ্বালিয়া কেন ব্রহ্মময়ীর রূপ দেখ না! সাকারে সাযুজ্য হবে নির্বাণে কী গুণ বলো না। কালী যার হৃদে জাগে, তর্ক তার লাগে কোথা?যে যে ভাবের বিষয়, ভাব ব্যতীত অভাবে কি ধরতে পারে! ত্যাজিব সব ভেদাভেদ ঘুচে যাবে মনের খেদ মা বিরাজে সর্বঘটে, তারা আমার নিরাকার।
মায়ার এ পরম কৌতুক। মায়াবদ্ধ জনে ধাবিত। অবদ্ধ জনে লুটে সুখ। ‘আমি’ এই ‘আমার’ এই এভাব ভাবে মূর্খ সেই। মনরে, ওরে মিছামিছি সার ভেবে, সাহসে বাঁধছি বুক। আমি কে বা তোমার কে বা? মন রে, ওরে কে করে কাহার সেবা? মিছা ভাবো সুখ-দুঃখ। দীপ জ্বেলে আঁধার ঘরে দ্রব্য যদি পায় করে (হাতে) মন রে, ওরে তখনি নির্বাণ করে না রাখেরে এতটুকু। প্রাজ্ঞ অট্টালিকায় থাকো, আপনি আপনা দেখো। রামপ্রসাদ বলে মশারী তুলে দেখরে আপনার মুখ।
ও মন, ভাবো শক্তি, পাবে মুক্তি। বাঁধো দিয়ে ভক্তি দড়া। নয় বা থাকতে না দেখলো মন, কেমন তোমার কপালপোড়া। যে-ই ধ্যানে (থাকে) এক মনে, সে-ই পাবে না তোমায় তাড়াতাড়ি।
ওরে মন বলি, ভজ কালী, ইচ্ছা হয় যেই আচারে। সদা গুরুদত্ত মন্ত্র করো, দিবা নিশি জপ করো। শয়নে প্রণাম জ্ঞান, নিদ্রায় করো মাকে ধ্যান। ওরে নগর ফিরো, মনে করো প্রদক্ষিণ শ্যামা মা-রে। যত শোন কর্ণপটে, সকলি মায়ের মন্ত্র বটে। কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী, বর্ণে বর্ণে নাম ধরে। কৌতুকে রামপ্রসাদ বটে, ব্রহ্মময়ী সর্বঘটে। ওরে আহার করো, মনে করো আহুতি দিই শ্যামা মা-রে।
মন রে! কৃষি কাজ জানো না? এমন মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে, ফলতো সোনা । কালী নামে দাওরে বেড়া, ফসলে তছরূপ হবে না। সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া। তার কাছেতে যম ঘেঁসে না । গুরুদত্ত বীজ রোপণ করে, ভক্তিবারি তাই সেচো না। ওরে একা যদি না পারিস মন, রামপ্রসাদকে সঙ্গে নে না।
কাজ কী রে মন, যেয়ে কাশী। কালীর চরণ কৈবল্যরাশি। সার্ধ ত্রিশ কোটি তীর্থ, মায়ের ও চরণবাসী। হৃৎকমলে ভাবো বসে, চতুভুজা মুক্তকেশী। রামপ্রসাদ এই ঘরে বসে পাবে কাশী দিবানিশি।
কে জানে রে কালী কেমন! ষড়দর্শনে না পাই দর্শন। কালী পদ্মবনে হংস সনে, হংসীরূপে করে রমণ। তাঁকে মূলাধারে সহস্রারে, সদাযোগী করে মনন। আত্মারামের আত্মাকালী, প্রমাণ প্রণবের মতন। তারা ঘটে ঘটে বিরাজ করেন, – ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন, মায়ের উদর ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড, প্রকাণ্ড তা জানো কেমন? মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম।