রচনা: পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য

রচনা: পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য
Admin June 13, 2024 126

ভূমিকা :

জগতে মাতাপিতার তুল্য, হৈতষী, পরম শ্রদ্ধাভাজন গুরু আর কেউ নেই। তাদের ত্যাগ তিতিক্ষার জন্য আমরা আজ এ সুন্দর পৃথিবীর আলো, বাতাস, রূপ-রস-গন্ধ ভোগ করতে পারছি। মাতাপিতার কাছে আমরা চিরঋণী। যে ঋণ শোধ করার ক্ষমতা কোন সন্তানের নেই। তাই তাঁদের প্রতি কর্তব্য পালন করা একান্ত কর্তব্য।

মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য :

মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য পালন যে কত গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ মানবজীবনের অখন্ডনীয় দলিল কোরআন এবং মানব আদর্শের প্রতীক হাদীসে প্রমাণিত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেন,
‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না এবং মাতাপিতার সাথে উত্তম আচরণ কর।’
মহামানব হযরত মুহম্মদ (স) বলেছেন,
‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’

হিন্দু শাস্ত্রে মায়ের স্থান উল্লেখ করে বলেছে-
‘জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ’

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকে আছে,
‘মাতাপিতার সেবা করাই সবচেয়ে উত্তম।’

পাশ্চাত্য মনীষী রাস্কিন বলেছেন এ পৃথিবীতে তিনটি কর্তব্য রয়েছে-
“Duty towards God, duty towards parents and duty towards mankind.”

সন্তানের প্রতি মাতাপিতার প্রত্যাশা ও দান : জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সন্তানের জীবনে মাতাপিতার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। মা-বাবার মনে সন্তানের প্রতি অপরিসীম কল্যাণ চেতনা কাজ করে। সন্তানকে বড় করে তোলার জন্য মা-বাবা সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেন। সন্তান কীভাবে সুখী হবে সেদিকে তাঁদের সব সময় খেয়াল থাকে।
“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে”

প্রত্যেক সন্তানের জন্য মাতাপিতার এ এক শাশ্বত কামনা। মাতৃগর্ভে মায়ের দেহের বিন্দু বিন্দু রক্তই এক সময় আমাদের অস্তিত্বের একমাত্র অবলম্বন ছিল। আর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাতাপিতাই হয়ে পড়েন আমাদের একান্ত আপনার, মঙ্গলকামী। মাতাপিতাই সন্তানের মঙ্গল কামনায় সর্বদা তটস্থ থাকেন। শিক্ষা-দীক্ষায়, কাজে-কর্মে সন্তানকে একজন আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলাই প্রতিটি পিতা-মাতার একমাত্র আরাধ্য বিষয়। সন্তানের মঙ্গলের জন্য এমন কোন কাজ নেই যা মাতাপিতা করেন না। মা-বাবা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান, নিজে না পরে সন্তানের পোশাকের ব্যবস্থা করেন। সন্তানের মুখে দুমুঠো খাবারের গ্রাস তুলে হাসি ফুটলেই তাঁদের মুখে হাসি ফোটে। সন্তানের জন্য উৎকণ্ঠায় মাতাপিতা বিনিদ্র রজনী যাপন করেন। সন্তান অসুস্থ হলে মা-বাবার চোখে ঘুম থাকে না। সন্তানের যে কোন অমঙ্গল মা-বাবার জন্য বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি বিপথগামী ও অবাধ্য সন্তানের জন্যও মা-বাবার মহানুভূতি ও ভালবাসা কোন অংশেই কম থাকে না। সন্তান প্রতিবন্ধী হলেও মাতাপিতা কম স্নেহ করেন না, মনের ভালোবাসার কোন কমতি থাকে না। সন্তানের জীবনে মাতাপিতার এই প্রভাবের প্রেক্ষিতে সন্তানের কর্তব্য হয়ে ওঠে সীমাহীন।

কর্তব্যের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব :

মাতাপিতার কষ্ট, ধৈর্য, সাধনা ও শ্রমের ফলশ্রুতি হিসেবে সন্তানের সুন্দর জীবন গড়ে ওঠে। মা-বাবা যদি সন্তানের প্রতি অবহেলা দেখান তবে সে সন্তান কখনই যথার্থ মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। যাঁরা এ বিশ্বে নিজেদের জীবনের কল্যাণকর বিকাশ দেখিয়েছেন এবং বিশ্বের বুকে স্বীয় গৌরব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তাঁরা শৈশবে সুযোগ্য মাতাপিতার স্নেহ ও শিক্ষায় লালিত-পালিত হয়েছেন। মাতাপিতার মহান ও সীমাহীন অবদানের প্রেক্ষিতে তাঁদের প্রতি কর্তব্য পালন করে বা তাঁদের সেবা করে তাঁদের এই ঋণ পরিশোধ করা যায় না। মা-বাবার প্রতি কর্তব্য পালনের অর্থ তাঁদের সাধনার প্রতিদান দেওয়া নয়। তাঁদের ঋণ পরিশোধ্য নয় একথা বিবেচনা করেই তাঁদের সর্বাধিক সুখ-শান্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাঁদের পূর্ণ সন্তুষ্টির দিকে সদাসর্বদা মনোযোগী হতে হবে।

কর্তব্যের ধরন :

সন্তানের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য মাতাপিতার অনুগত ও বাধ্য হওয়া। মাতাপিতার অবাধ্য হলে তারা যেরূপ ব্যাথিত হন, এমন আর কিছুতেই হন না। রাম পিতৃসত্ব পালনের জন্য চৌদ্দ বছর বনবাস করেছিলেন, ভীমসেন মাতার আজ্ঞায় রাক্ষসমুখে যেতেও দ্বিধাবোধ করেন নি। শাস্ত্রে আছে বিদ্বান এবং ভক্তিমান নয় এমন সন্তানের জন্মের প্রয়োজন নেই। সর্বদা পিতা-মাতার সাথে ভদ্রতা ও নম্রতার সাথে মার্জিত ভাষায় কথা-বার্তা বলা প্রত্যেকটি সন্তানের জন্য একান্ত কর্তব্য। তাছাড়া পিতা-মাতার বৃদ্ধাবস্থায় যখন তারা চলতে ফিরতে অক্ষম হয়ে পড়েন তখন তাঁদেরকে চলতে ফিরতে সাহায্য করা, রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে সেবা-যত্ন করা। সন্তান যখন বড় হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করে তখন মাতাপিতার ভরণপোষণের ভার পড়ে সন্তানের ওপর। মা-বাবার তখন বয়স বেড়ে প্রৌঢ়ত্বে বা বার্ধক্যে পৌঁছান। তাঁদের কর্মজীবন থেকে অবসর নিহে হয়। অনেকেই তখন সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় সব রকম সুখের ব্যবস্থা করা সন্তানের কাজ। নিজের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও মাতাপিতার সুখের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। মোটকথা, শৈশবে আমাদের অসহায় মুহূর্তে মাতাপিতা যেমনি আমাদের একান্ত অবলম্বন ছিলেন ঠিক তেমনিভাবে বৃদ্ধাবস্থায় তাদেরকে ছায়ার মত অনুসরণ করা প্রত্যেকটি সন্তানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন,
“পিতা-মাতার সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করবে।”

তিনি আরো বলেন তোমরা পিতা-মাতার জন্য সর্বদা দোয়া প্রার্থনা কর-
‘হে আল্লাহ, আমার পিতা-মাতা শৈশবে যেমন স্নেহ মমতা দিয়ে আমাকে লালন পালন করেছিলেন, আপনি তাঁদের প্রতি তেমনি সদয় হোন।’

যে সন্তান পরিণত বয়স পর্যন্ত মাতাপিতার সেবা করার সুযোগ পান তিনি ধন্য। স্বীয় কর্ম ও চরিত্র দ্বারা মাতাপিতার তুষ্টিসাধন করা সন্তানের একান্ত কর্তব্য। আজকাল অনেক সন্তানকে মাতাপিতার প্রতি বিরাগী হতে দেখা যায়; এমন কি মাতাপিতাকে ঘৃণার চক্ষে দেখে এমন কুপুত্রেরও অভাব হয় না। যে মাতাপিতা জন্ম দিয়েছেন, শিক্ষিত হয়ে সে মাতাপিতাকে অবহেলা করা যে কত বড় পাপ তা কল্পনাও করা যায় না। সে সন্তান নরকগামী হয়। যে সন্তান প্রাণপণে মাতাপিতার তুষ্টিসাধন করতে পারে তার জীবন ধন্য- তার জন্ম সার্থক।

মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য পালনের মহান দৃষ্টান্ত :

এই বিশ্ব চরাচরে আজ যাঁরা অমরত্বের স্বাদ নিয়ে মানব হৃদয়ে বেঁচে আছেন তাদের অধিকাংশেরই জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা প্রত্যেকেই পিতৃ-মাতৃভক্তির এক একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হযরত বায়েজীদ বোস্তামী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির চিরকালই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে দীপ্যমান। এছাড়া, হযরত আব্দুল কাদির জিলানী, হাজী মুহম্মদ মহসীন, জর্জ ওয়াশিংটন ও আলেকজান্ডার প্রমুখ ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণ মাতাপিতার প্রতি যে শ্রদ্ধাভক্তি দেখিয়েছেন তা যুগ-যুগান্তরে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

শিক্ষাজীবনে ও ছাত্রজীবনে কর্তব্য :

মাতাপিতার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের কর্তব্য খুবিই গুরুত্বপূর্ণ। শৈশবে লেখাপড়াকালীন অবস্থায় সন্তানের প্রধান কাজ হবে মা-বাবার স্বপ্ন সফল করে তোলার জন্য নিরলস সাধনা করা। সন্তান লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক এটাই তাঁদের কামনা। সন্তান যোগ্য হয়ে পরবর্তী জীবনে কতটুকু সাহায্য করবে এ কথা কখনোই কোন বাবা-মা ভাবেন না। তাঁরা চান সন্তান বড় হয়ে মানুষ হোক। এই অবস্থায় প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর কাজ হবে মাতাপিতা যেভাবে জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা দান করেন সেভাবেই তাদের চলা। যেহেতু তাঁরা কখনই সন্তানের অকল্যাণ কামনা করেন না, সেজন্য তাঁদের আদেশ-নিষেধ বিনা বাক্যব্যয়ে পালন করতে হবে। মাতাপিতার আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে সন্তানদের চলতে হবে। আজকাল সমাজ যে অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে তাতে মাতাপিতারা নিজেদের সন্তান নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। সন্তানদের কার্যকলাপ যদি মাতাপিতার উদ্বেগাকুল হৃদয়কে শান্ত রাখতে পারে তাহলেই তাঁদের প্রতি যথার্থ কর্তব্য পালন করা সম্ভব হবে।

উপসংহার :

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে আকাশের চেয়ে উঁচু যদি কিছু থাকে তবে তা পিতা এবং পৃথিবীর চেয়ে যদি গুরু ভার কিছু থাকে তবে তা মাতা। সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য স্বীকারের পরই মাতাপিতার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালন সকল ধর্মে স্বীকৃত। কাজেই কোন অবস্থাতেই মাতাপিতাকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। কারণ মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য পালনের মধ্যে রয়েছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক শান্তি ও মুক্তির পথ।