রচনা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের সংস্কৃতি

রচনা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের সংস্কৃতি
Admin June 13, 2024 111

ভূমিকা:

স্বাধীনতা মানুষের অনন্ত পিপাসা। এ পিপাসা থেকেই মানুষের মনে জন্ম হয় সংগ্রামী চেতনার। আর এ সংগ্রামী চেতনাবোধই মানুষের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথকে সুগম করে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা বাঙালি। স্বাধীন বাংলাদেশের অধিবাসী। কিন্তু এ দেশ এক সময় পরাধীন ছিল। সুদীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, অর্জন করেছি কথা বলার অধিকার, অর্জন করেছি এই স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে এক অহঙ্কার, এক স্মরণীয় অধ্যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একখণ্ড ভূমি অধিকার করার যুদ্ধ নয়, এ যুদ্ধের চেতনা ছিল অনেক গভীরে; আত্মমুক্তি ও আত্মবিকাশের আকাঙ্ক্ষার লালিত স্বপ্ন।

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধের রয়েছে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের হাতে পরাজিত হন। সে দিন থেকে বাংলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। শুরু হয় ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসন। দু’শ বছর ধরে চলতে থাকে ইংরেজদের শোষণ আর নির্যাতন। শাসন-শোষণ, লাঞ্ছনা আর নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বাঙালি জাতির মনের কোণে জন্ম নিয়েছিল বিক্ষোভ, আন্দোলন আর সংগ্রামের চেতনা। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের একাংশরূপে জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে শাসকবর্গের বাঙালি নিধনের ইতিহাস নতুন কোনো ঘটনা নয়। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ইতিহাস বাঙালিদের হত্যা ও বঞ্চনারই ইতিহাস। জাতীয় জীবন থেকে এ হতাশা মুছে ফেলার জন্য বাঙালিদের করতে হয়েছে ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ।


২৫ মার্চ কালরাত :

ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর আহুত অসহযোগ আন্দোলন যখন সারা বাংলায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে তখন ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। শুরু হয় ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে ঘেরা তাদের প্রহসনমূলক আলোচনা। অতঃপর ২৫ মার্চ রাতে আলোচনার সমাপ্তি ঘোষণা না করেই ইয়াহিয়া-ভুট্টো রাতের আঁধারে পশ্চিম পাকিস্তানে পলায়ন করেন। ২৫ মার্চ কালরাতেই শুরু হয় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর জল্লাদ বাহিনীর বর্বরোচিত নগ্ন হামলা। এ সময় বন্দি হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে শেখ মুজিব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে সকলকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করার আহ্বান জানান।


প্রতিরোধ যুদ্ধ :

বাঙালি জনসাধারণ অসীম সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। লক্ষ নিরস্ত্র বাঙালিগণ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হিংস্রতা থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য মৃত্যুর দুর্জয় শপথ নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। তারা বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রেলালাইন, ব্রিজ ধ্বংস করে প্রতি পদক্ষেপে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন করতে থাকে।

মুজিবনগর সরকার :

স্বৈরাচার ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ বাহিনী যখন বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে থাকে ঠিক তখনই কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে (বর্তমান মুজিব নগর) বাংলার রাজনৈতিক নেতৃবর্গ সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে স্বাধীন বাংলার নতুন সরকার গঠন করেন। অতঃপর জাতীয় পরিষদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে স্বাধীন বাংলার সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। মুজিব নগর সরকার নবগঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দেন।


মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ :

মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর ভূমিকা ছিল অন্যতম। ছাত্র ও যুবকরা শত্রুকে আঘাত হানার জন্য প্রয়োজনীয় রণকৌশল শিখে দ্রুত বাংলার বনে-জঙ্গলে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে ঢুকে আক্রমণ শুরু করে। মুক্তি বাহিনীর গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্রমে তারা ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা প্রভৃতি বড় শহরে পাক বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানতে শুরু করে। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে তারা দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা, যশোরসহ বিস্তৃত এলাকা মুক্ত করে হানাদার বাহিনীর মনোবল ধ্বসিয়ে দেয়।

যৌথ বাহিণীর আক্রমণ ও চূড়ান্ত বিজয় :

অতঃপর মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হয় যৌথ কমান্ড। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালিত হয় আকাশ পথ, স্থলপথ এবং জলপথে। সম্মিলিত বাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী শীঘ্রই নাজেহাল হয়ে পড়ে। মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ডের প্রচণ্ড আঘাতে পাক-হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। অতঃপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এ কে নিয়াজী ৯৩ হাজার সৈন্যসহ যৌথ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জগজিৎ সিং আরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করেন। অবশেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্থায়ী আসন লাভ করে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বরূপ :

অনেক রক্ত আর অসংখ্য জীবনের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির জীবনে তাই স্বাধীনতার চেতনা যেমন গভীর, তেমনি ব্যাপক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি সেসব শহীদদের কথা, সেসব অসম সাহসী বীর যোদ্ধাদের কথা, যারা তাদের আত্মবলিদানের জন্য অমর হয়েছেন, তারাই আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন চিরকাল।’ যে চেতনা ও সাহস নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের সেই যথার্থ প্রতিফলন এখনো ঘটেনি। বরং জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে আজ মিথ্যার মলিনতা বিদ্যমান। ফলে আমাদের সব গৌরবই যেন ঢেকে যেতে বসেছে। মানবিক মূল্যবোধ আজ প্রায় নিঃশেষিত ও বিপন্ন। এমতাবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এত কষ্টে অর্জিত এ স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটুকু অটুট ও অক্ষত থাকবে, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে পারব?

সংস্কৃতি :

সংস্কৃতি হলো মানুষের আচার-আচরণের সমষ্টি। মানুষের জাগতিক নৈপুণ্য ও কর্মকুশলতা, তার বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষা, নৈতিকতা, রাজনীতি, ভাষা, কলা, মূল্যবোধ সবকিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজের মানুষের অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নীতি, নিয়ম, সংস্কার ও অন্যান্য যে কোনো বিষয়ে দক্ষতার সর্বাধিক সমাবেশ। মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে বাঁচা।’ তবে সংস্কৃতি শনাক্তকরণের কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নেই, গণ্ডি নেই। এটি চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি। এলাকাভিত্তিক এর ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। একটা নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের জীবন প্রণালী অর্থাৎ মানুষের দৈনন্দিন আচার-আচরণ, কজকর্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ, প্রচলিত লোককাহিনী, ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান, চিন্তা-চেতনা সবকিছুই সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে।

সাংস্কৃতিক জীবনে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব :

‘সংস্কৃতি’ বলতে শুধু সুকুমার কলার চর্চা নয়, সংস্কৃতি হলো একটি জাতির আত্মবিকাশ ও আত্মোপলব্ধির এক প্রভাবশালী প্রত্যয়। বিভেদ যেখানে, সংস্কৃতি সেখানে নেই। হিংসা যেখানে আছে, সেখানে সংস্কৃতি নেই। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির স্লোগান ছিল সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার, প্রাণের অধিকার, বাঁচার আন্দোলন। এ আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল ভালোবাসা, দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা, দেশের ভাষা-কৃষ্টি ও লালিত আচার-আচরণকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা, দেশের ভাষা-কৃষ্টি ও লালিত আচার-আচরণকে ভালোবাসা। আমাদের সংস্কৃতি চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ এক বলিষ্ঠ প্রত্যয়ী অনুপ্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরকে ত্যাগ করতে শিখিয়েছে, বিভেদ ভুলে একতার জয়গান গাইতে অনুপ্রাণিত করেছে। আজ আমরা স্বাধীন ভূমি পেয়েছি। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আজ যে জাগরণ এসেছে, তার মূলে রয়েছে ’৫২-এর অমর একুশ, আছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা আমাদের যে চেতনা, যে ত্যাগ, যে শিক্ষা দিয়ে গেছে, তার ওপরই গড়ে উঠেছে আমাদের বর্তমান সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। সুতরাং আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে মুক্তিযুদ্ধের এক বিশেষ প্রভাব রয়েছে।

উপসংহার :

বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি বলিষ্ঠ চেতনা, আত্মপ্রত্যয়েল দৃঢ় উচ্চারণ। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ মনীষী সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী লিখেছেন, ‘আলোক ব্যতীত যেমন পৃথিবী জাগে না, স্রোত ব্যতীত যেমন নদী টেকে না, স্বাধীনতা ব্যতীত তেমনি জাতি কখনো বাঁচিতে পারে না।’ আমরাও সেই চিরন্তন সত্যের পথ ধরেই ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছি আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক সেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যে বোধ বা চেতনাকে কেন্দ্র করে তারই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তাকে চির সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে আবহমান কাল ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রেরণা যোগাবে এ জাতিকে, যা সংস্কৃতি চেতনার ও বলিষ্ঠ প্রত্যয়ী অনুপ্রেরণা।