রচনা : মানব কল্যাণে বিজ্ঞান

রচনা : মানব কল্যাণে বিজ্ঞান
Admin June 26, 2024 186

ভূমিকা :

বিজ্ঞান বা ‘science’ শব্দটির উৎপত্তি ‘socio’ থেকে। ‘socio’ অর্থ জানা বা শিক্ষা করা। শাব্দিক অর্থে বিশেষ জ্ঞানই হল বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের দর্শনে পার্থিব জগতের নানা বিষয় নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘বিজ্ঞান জগৎ’। আর বিজ্ঞানের এই জগৎ ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে পৌঁছে দিয়েছে আধুনিক সভ্য ইতিহাসের মনিকোঠায়। আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ। মানুষ ও তার জীবনদানকারী সভ্যতাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসেছে এই বিজ্ঞান। মানব কল্যাণে বিজ্ঞানের অবদান যে কত ব্যাপক তা প্রতিদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করা যায়। বিজ্ঞান আজ মানবজীবনে নিত্য সঙ্গী। আদিম যুগ থেকে আরম্ভ করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানবসভ্যতার যে বিকাশ ঘটছে, তার মূলে রয়েছে বিজ্ঞান। 

আধুনিক বিজ্ঞান :

সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর হয়ে বিজ্ঞান বর্তমান পূর্ণরূপে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। বিজ্ঞানের অসীম শক্তিতে মানুষ আজ প্রকৃতিকে যেন হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। বিজ্ঞানের অভিযান শুরু হয়েছে সুদূর অতীতে। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে এর অগ্রগতি অত্যন্ত বিস্ময়কর। এই শতাব্দীতেই বিজ্ঞান মানুষকে দিয়ে অনিঃশেষ সম্ভাবনার অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা।

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার :

প্রাচীনকালে, বিজ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত মানুষ ছিল প্রকৃতির হাতের এক ক্রীড়নক। গুহাবাসী সেই পশুসদৃশ মানুষ যখন প্রথম পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালায় তখন থেকেই শুরু হয় মানুষের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। তারপর যেখানেই বাধার সম্মুখীন হয়েছে, কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে, মানুষ ব্যবহার করেছে বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেই মানুষ এখন সমগ্র পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। মানব সমাজের যে দিকেই দৃষ্টিপাত করা যায়, শুধু বিজ্ঞানের মহিমাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানের বলে মানুষ জল, স্থল, অন্তরীক্ষ জয় করেছে, মানুষের সংকট নিবারণের ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের বহু অভাবনীয় কৌশল আবিষ্কার করেছে। বিদ্যুৎ, আণবিক শক্তি, কম্পিউটার প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার। 

বিজ্ঞানীর আত্মত্যাগ :

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে যুগ যুগ ধরে বহু বিজ্ঞানীর নিরলস শ্রম, মেধা, সাধনা, অধ্যবসায়, জড়িত। জড়িত রয়েছে অনেক বিজ্ঞানীর আত্মত্যাগ। সত্যকথা বলেছিলেন বলে বিজ্ঞানী ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, ল্যাভয়সিয়কে হত্যা করা হয়েছিল গিলোটিনে। মহান বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস, কোপর্নিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখ অসংখ্য বিজ্ঞানী তাঁদের সমগ্র জীবন বিজ্ঞানের পিছনে ব্যয় করেছেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই বর্তমানে মানুষ অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের যুগে উন্নীত হতে পেরেছে। 

মানবজীবনে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক অবদান :

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মানুষের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিজ্ঞান জড়িত। মানবজীবন আর বিজ্ঞান একই সূত্রে গ্রথিত। যাতায়াত, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ জীবনের হাজারো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। নিচে এর কয়েকটি দিক তুলে ধরা হল। 

দৈনন্দিন বিজ্ঞান :

জীবনযাত্রার সকল দিকের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে বিজ্ঞান আজ নিয়োজিত। ব্যক্তি জীবনে প্রভাতী চা পানের সময় থেকে অফিসে গমনাগমন এবং নিদ্রার পূর্বমুহূর্তে যাবতীয় সকল বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে বিজ্ঞান। বিজলীবাতি, পাখা, মোটর গাড়ি, উড়োজাহাজ, হিটার, চুল্লি ইত্যাদি সকল কিছুই সহজলভ্য হয়েছে বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে। 

নাগরিক সভ্যতায় বিজ্ঞান :

নাগরিক সভ্যতা সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞানের দান। বিজলী বাতিতে রাস্তা ঘাট, বাড়ি ঘর, সবকিছু ঝলমল করে। কয়েকটি বৈদ্যুতিক সুইচে আঙ্গুলি চালনার ফলে প্রত্যহ রান্না, পাখা চালনা ইত্যাদি সব কিছুই সম্ভব হচ্ছে। 

পরিবহণ ও যোগাযোগে বিজ্ঞান :

যাত্রী নিয়ে আজ উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ে, জলযান সমুদ্র পাড়ি দেয়, শত সহস্র মাইল দূর থেকে মানুষের সংবাদ আদান-প্রদান করে টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার ও টেলিফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল, ইন্টারনেট এ সবই বিজ্ঞানের আশীর্বাদ।

চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান :

চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান আজ যুগান্তর এনেছে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যা আজ হ্রাস পেয়েছে। স্ট্রেপটোমাইসিন, পেনিসিলিন, এক্সরে প্রভৃতি আজ মৃত্যুপথযাত্রীকে দান করেছে নিশ্চিত বিশ্বাস ও আশা। কর্নিয়া (অক্ষিগোলকের স্বচ্ছ আবরণ), বৃক্ক, অস্থিমজ্জা, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস এবং যকৃতের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক সাফল্য অভাবনীয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ফাইবার অপটিকস্ (আলোক তন্তু বিদ্যা) ব্যবহারের ফলে মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ ফুসফুস, পাকস্থলী, বৃহদন্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র, উদর, অস্থিগন্থি, শিরা, ধমনী ইত্যাদির অবস্থা যন্ত্রের সাহায্যে অবলোকন করে নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়। শুধু তাই নয়, অপটিক ফাইবার (আলোক তন্তু) সংবলিত বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্যে নমুনা সংগ্রহ করা যায়। অতিকম্পনশীল শব্দ ও লেজারকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞান চিকিৎসাক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছে। এর ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন দেখা সম্ভব হচ্ছে তেমনি মূত্রথলি ও পিত্তকোষের পাথর চূর্ণ করার কাজেও এর সফল ব্যবহার হচ্ছে। কম্পিউটার প্রযুক্তি চিকিৎসাবিজ্ঞানকে নিয়ে এসেছে সর্বাধুনিক পর্যায়ে।

শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান :

শিল্পকারখানায় পূর্বে সমস্ত কাজই হাতে করা হতো। বিজ্ঞানের বলে আজ সেসব কাজ যন্ত্র দ্বারা করানো হচ্ছে। ফলে খরচ কম পড়ছে, সময় কম ব্যয় হচ্ছে এবং অধিক উৎপাদন হচ্ছে। 

জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞান :

জনসংখ্যা বর্তমান বিশ্বের এক নম্বর সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বিজ্ঞানেরই আবিষ্কার। মানুষ এই বিজ্ঞানের বলেই জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে সরঞ্জামাদি আবিষ্কার করেছে এবং নব নব পদ্ধতি আবিষ্কার করে চলেছে। 

মহাশূন্যের রহস্য উদ্ঘাটনে বিজ্ঞান :

মানুষের কৌতূহলী মন আজ বিজ্ঞানের বলে মহাশূন্যের রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যাপৃত হয়েছে। মানুষ চাঁদে, মঙ্গল গ্রহে অভিযান চালিয়েছে। মানুষ বিভিন্ন গ্রহ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের জন্যে মহাশূন্যে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে। মহাকাশে পাঠিয়েছে বিভিন্ন উপগ্রহ যান, রোবট ও অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম। 

শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারে বিজ্ঞান :

মুদ্রণ যন্ত্র, ক্যালকুলেটর, কাগজ, জ্ঞান আহরেণের জন্যে সংবাদপত্র ও পুস্তকাদি সবকিছুই বিজ্ঞানের দান। চলচ্চিত্র, বেতার যন্ত্র, টেলিভিশন প্রভৃতি যেমন মানুষকে অফুরন্ত আনন্দ দিচ্ছে, তেমনি শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে। কম্পিউটার বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত করেছে এক নতুন শিক্ষ-পদ্ধতি। বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা এখন কম্পিউটারেই শিখতে পারছে অসংখ্য জিনিস। তাছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন বিখ্যাতি লাইব্রেরির বই, বিখ্যাত শহর-বন্দর; বাণিজ্য, দেশ ইত্যাদি সম্পর্কে মুহূর্তেই সংগ্রহ করতে পারছে বিভিন্ন উপাত্ত। 

কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান :

আধুনিক বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রেও অশেষ কল্যাণ সাধন করে আসছে। প্রাচীন ভোঁতা লাঙ্গলের পরিবর্তে আজ ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নতমানের কলের লাঙ্গল ও ট্রাক্টর। পচা আবর্জনা ও গোবরের সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক রাসায়নিক সার। গবেষণার মাধ্যমে উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে। উন্নতমানের উদ্ভিদ উৎপাদন করা হচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রেও বিজ্ঞান মহাবিপ্লব এনেছে। 

আবহাওয়ায় বিজ্ঞান :

বিজ্ঞানীরা মহাকাশে প্রেরণ করেছে কৃত্রিম উপগ্রহ। যার ফলে আবহাওয়ার খবরাখবর মুহূর্তেই নির্ভুলভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে খনিজ সম্পদ, তেল ও গ্যাসের উৎস, মাটির উপাদান ও জলজ সম্পদ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। 

অপকারিতা :

বিজ্ঞান কেবল আশীর্বাদই বহন করে না, অভিশাপও বহন করে। এটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, ডিনামাইট, বোমারু বিমান, ট্যাংক ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে মানব-জীবন বিজ্ঞান আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা কর্তৃক হিরোশিমার নিক্ষিপ্ত বোমা ও তার ধ্বংসলীলা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। 

উপসংহার :

অনেকে বিজ্ঞানের বিভীষিকা সৃষ্টির শক্তি ও ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে বিজ্ঞানকে দোষারোপ করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানই মানুষকে পর্যায়ক্রমে শান্তি ও সমৃদ্ধি দিয়েছে। মানুষের সভ্যতাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিজ্ঞান। মানুষ যদি তার শক্তির অপব্যবহার না করে শুভ বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয় এবং বিজ্ঞানকে সভ্যতার বিকাশে কাজে লাগায়, তবে বিজ্ঞান অভিশাপ না হয়ে আশীর্বাদই হবে।