রচনা : মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার

রচনা : মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার
Admin June 17, 2024 105

ভূমিকা :

আধুনিক বিশ্বে নিত্যনতুন আবিষ্কার মানব জীবনকে একদিকে যেমন দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য ও গতিময়তা, অন্যদিকে তেমনি সঞ্চারিত করেছে হতাশা ও উদ্বেগের। পুরাতন সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে দিনে দিনে, নতুন মূল্যবোধও সবসময় গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। সামগ্রিকভাবে হতাশা, আদর্শহীনতা, বিভ্রান্তি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক-ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি নানাবিধ কারণ যুবসমাজকে মাদকাসক্ত করে তুলছে। তাই বর্তমান বিশ্বসভ্যতা যে কয়টি মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন, মাদকাসক্তি তার অন্যতম।

মদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তি :

মাদকদ্রব্য হচ্ছে সেসব বস্তু যা গ্রহণের ফলে স্নায়ুবিক বৈকল্যসহ নেশার সৃষ্টি হয়। সুনির্দিষ্ট সময় পর পর তা সেবনের দুর্নীতি আসক্তি অনুভূত হয় এবং কেবল যেসব মাদকদ্রব্যের সেবক সর্বাধিক সেগুলো হলো গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, রেকটিফাইড স্পিরিট, মদ, বিয়ার, তাড়ি, পঁচুই, ঘুমের ওষুধ, প্যাথেড্রিন ইনজেকশন ইত্যাদি। এসব মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে নেশা সৃষ্টিকে মাদকাসক্তি বলা হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, মাদকাসক্তি হচ্ছে চিকিৎসা গ্রহণযোগ্য নয় এমন দ্রব্য অতিরিক্ত পরিমাণে বিক্ষিপ্তভাবে গ্রহণ করা এবং এসব দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।

    মাদকাসক্তির কারণ :

    মাদকাসক্তির কারণ বহুবিধ। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানী, গবেষক। চিকিৎসকরা মাদকাসক্তির অন্তরালে যে কারণগুলো সক্রিয় বলে চিহ্নিত করেছেন সেগুলো নিচে আলোচিত হলো :


    ১. সঙ্গদোষ : মাদকাসক্তির জন্য সঙ্গদোষ একটি মারাত্মক কারণ। কারণ কোনো বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত হলে সে তার সঙ্গীদেরও নেশার জগতে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে সুস্থ সঙ্গীটিও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সেজন্য বলা হয়ে থাকে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’

    ২. কৌতূহল : কৌতুহলও মাদকাসক্তির একটি মারাত্মক কারণ। মাদকাসক্তির ভয়াবহতা জেনেও অনেকে কৌতূহলবশত মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে। এভাবে একবার দুবার গ্রহণের ফলে এক পর্যায়ে সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

    ৩. সহজ আনন্দ লাভের বাসনা : মানুষ অনেক সময় আনন্দ লাভের সহজ উপায় হিসেবে মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

    ৪. পারিবারিক কলহ : প্রতিটি সন্তানই চায় তার পরিবারের অভ্যন্তরে মা ও বাবার মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকুক। কিন্তু অনেক পরিবারে মা ও বাবার মধ্যে সুসম্পর্কের পরিবর্তে প্রায়শ দ্বন্দ্ব ও কলহ লেগে থাকে, যা অনেক সন্তানই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। ফলে এক পর্যায়ে এসব সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে অন্যভাবে মানসিক প্রশান্তি খোঁজার চেষ্টা করে।

    ৫. ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচ্যুতি : ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জ্ঞান মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ ও ভ্রাতৃত্বের বিকাশ ঘটায় এবং মানুষকে চরিত্রবান করে তুলে সঠিক পথে পরিচালিত করে। কিন্তু সাম্প্রতিক ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতি মাদকাসক্তি বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।


    ৬. মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা : নেশাজাতীয় বস্তুটি যদি মানুষের হাতের কাছে না থাকে তবে মানুষ নেশা বা মাদকাসক্ত হবার সুযোগ কম পাবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে অনেকটা প্রকাশ্যেই মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় হয়। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতার কারণে মাদকাসক্তদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।

    মাদকাসক্তি ও বিপন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম :

    বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং চোরাচালানের মাধ্যমে এর ব্যাপর প্রসার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। মাদকের নিষ্ঠুর ছোবলে অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ এবং অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে বহু তরুণের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো :


    ১. যুবসমাজের ওপর প্রভাব : মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচার আমাদের দেশের যুবসমাজের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। প্রেমে ব্যর্থতা, হতাশা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, কৌতূহল প্রভৃতির কারণে আমাদের দেশের যুবসমাজের এক বিরাট অংশ মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। মাদকদ্রব্যের ওপর এ নির্ভরশীলতা যুবসমাজের এক বিরাট অংশকে অবচেতন ও অকর্মণ্য করে তুলেছে।

    ২. সামাজিক বিশৃঙ্খলা : যারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে তারা যে কোনো উপায়ে মাদকজাতীয় দ্রব্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মাদকাসক্তরা মাদকদ্রব্য সংগ্রহের জন্য চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়। এভাবে সমাজের বিভিন্ন জায়গায় সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে।

    ৩. নৈতিক অধঃপতন : মাদকদ্রব্যের সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক, পাপ এবং পতিতাবৃত্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বাহ্যিক আচরণ বা মুখোশ খুলে যায়। আসক্তদের বিবেক লোপ পায়। ফলে অতিরিক্ত মাদক সেবনের পর স্বভাবতই যৌনসংক্রান্ত যে কোনো ব্যাপারে ব্যক্তির মাঝে চরম নৈতিক অধঃপতন দেখা দেয়।

    ৪. সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় : মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা যেহেতু আসক্ত হবার পর তাদের চেতনা হারিয়ে ফেলে, তাই পরবর্তীকালে তারা পূর্বের আদর্শ ও মূল্যবোধ ধরে রাখতে পারে না। আমাদের দেশের মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে ক্রমেই সরে পড়ছে।

    ৫. অপরাধপ্রবণতার হার বৃদ্ধি : আমাদের দেশে মাদকাসক্তি সমস্যা ক্রমাগতভাবে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি করছে। নেশা গ্রহণের ফলে ব্যক্তির মাঝে অস্বাভাবিকতা, অপ্রকৃতিস্থতা, বিচারবুদ্ধিহীনতা ও পাশবিকতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্চে। আসক্ত ব্যক্তির মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির ফলে সমাজে অপরাধ ও অনাচার বেড়ে যাচ্ছে।

    মাদকাসক্তি সমস্যা সমাধানের উপায় :

    বিশ্বজুড়ে মাদকাসক্তি একটি জটিল সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় এ সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রতিকারমূলক ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। নিচে এসব ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হলো :

    ক. প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ : মাদকাসক্তদের শারীরিক, মানসিক ও পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বলা হয়। আসক্ত ব্যক্তিদের প্রথমে তার পরিবেশ থেকে সরিয়ে আনা হয়, যাতে সে আর পুনরায় মাদক গ্রহণ করার সুযোগ না পায়। পরে তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করার জন্য কোনো চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে ব্যক্তি পরিপূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে তার হারানো ক্ষমতা ফিরে পায় এবং স্বাভাবিকভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

    খ. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা : মাদকাসক্তির করাল ছোবল থেকে সমাজ ও সমাজের মানুষকে রক্ষা করার জন্য যেসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয় তাকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলে। মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয় সেগুলো নিম্নরূপ :

    ১. মাদকদ্রব্যের উৎপাদন ও আমদানি নিষিদ্ধকরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা।

    ২. স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পাঠ্যসূচিতে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা।

    ৩. বিভিন্ন সভা, সমিতি, সেমিনার, আলোচনা ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রচারের মাধ্যমে মাদক প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা।

    ৪. মাদক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়ন করা।

    উপসংহার :

    পরিশেষে বলা যায়, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারজনিত সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী। লাভজনক এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক চোরা-চালানী চক্র গড়ে উঠেছে। এ সমস্যার ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ‘এ বিশ্বকে মাদকমুক্ত করা এক বিশাল সমস্যা।’ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় ও প্রতিরোধ আন্দোলনে আপামর জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে।