রচনা: ধর্মঘট ও হরতাল

রচনা: ধর্মঘট ও হরতাল
Admin June 20, 2024 103

ভূমিকা:

ইংরেজি ‘স্ট্রাইক’ শব্দের অর্থ বাংলায় ‘ধর্মঘট’। ধর্মঘট কথাটির ব্যবহার এসেছে ধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে ঘট- এই অভিধা থেকে। বর্তমানে এর অর্থ দাঁড়িয়েছে কোনো ন্যায্য দাবি পূরণ বা আদায়ের জন্যে কর্মচারীগণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দলবদ্ধভাবে কর্মবিরতিকরণ। অন্যদিকে ‘হরতাল’ শব্দটি এসেছে গুজরাটি ভাষা থেকে। এর আভিধানিক অর্থ বন্‌ধ বা বন্ধ করে দেওয়া। শব্দটির গঠন এরকম : হর (প্রত্যেক) + তাল (তালা)। অর্থাৎ প্রতি দরজায় তালা। আজকাল এর অর্থ- বিক্ষোভ ও ধর্মঘট আজ আমাদের জাতীয়জীবনে যে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে একথা কোনো মতেই অস্বীকার করা যায় না। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। 

ধর্মঘটের ইতিহাস:

ধর্মঘট কোথায় কখন প্রথম শুরু হয়েছিল তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় গৃহনির্মাণ শ্রমিকরা কাজের সময় কমিয়ে সর্বাধিক দশ ঘণ্টা করার দাবিতে যে ধর্মঘট করেন তাই সংঘটিত প্রথম ধর্মঘট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কয়েক দশক পরে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় শিকাগো শহরে মে দিবসে যে ব্যাপক ধর্মঘট পালিত হয় তা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে আছে। 


ধর্মঘটের স্বরূপ ও এর প্রভাব:

ধর্মঘট বা হরতাল শ্রমিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বলা চলে। তবে বিভিন্ন শ্রেণীর শ্রমজীবী ও বুদ্ধিজীবী জনগণ এবং ছাত্রসমাজও মাঝে মাঝে ধর্মঘট করে থাকেন। আমাদের সমাজে সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ইত্যাদি অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণ ধর্মঘট দেখা যায় না। ধর্মঘটের ঐতিহ্য এদেশে ছিল না, পাশ্চাত্যের ভাল-মন্দ উপকরণের মত ধর্মঘটও পশ্চিম থেকে এসে এদেশের মানুষের জীবনাচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। ধর্মঘট আগে ছিল অসন্তুষ্ট, দুর্বল শ্রমিকের সবল প্রতিবাদ। আর এখন তা রূপ নিয়েছে সর্বস্তরের সকলপ্রকার প্রতিরোধের বলিষ্ঠ হাতিয়ারে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় হরতালের কোনো নিয়মনীতি নেই, যে কোনো কারণে, যে কোনো সময় হরতাল হতে পারে। হরতাল এখন আর শ্রমিকনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, হরতাল প্রবেশ করেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বগণ হরতালকে রাজনীতিজীবনের আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কোনো সরকারের আমলে কিংবা বিরোধীদল হিসেবে কে কতবার এবং কত দিন হরতাল দিয়েছে তার পরিসংখ্যান চলে। এটা জাতির জন্যে কতখানি লজ্জাজনক, কতটা বিপজ্জনক- তার ফল এখনই আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। আমাদের দেশের হরতালকে নিঃসন্দেহে সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত করা যায়। হরতাল মানে গাড়ি ভাঙচুর, দোকানপাট ভাঙচুর, ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি, দেশের জান-মাল আগুনে পুড়িয়ে দেয়া, গোলাগুলি করা- এই হল আমাদের দেশের হরতাল। হরতালের এই বাস্তব চিত্রকে অস্বীকার করবেন, এমন দেশের রাজনীতিবিদ্‌দের প্রতি মানুষের এখন ঘেন্না ধরে গিয়েছে। দেশের প্রতি সরকারের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। জাতীয় অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে, দেশকে স্বাবলম্বী করতে হলে, দেশের মঙ্গল চাইলে এই মানুষ মারার হরতাল বন্ধ করতে হবে। 


ধর্মঘট বা হরতালের কারণ:

ধর্মঘট প্রধানত শ্রমিকশ্রেণীকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত। ধনতান্ত্রিক সমাজ সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক ও পুঁজিপতিদের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে পরিচালিত হয়। ফলে, সেখানে শ্রমিকরা হন উপেক্ষিত। তাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করেন, উৎপাদন বাড়ান, অথচ বাঁচবার উপযুক্ত মজুরি পান না। অনেক সময় তাঁদের কাজেও কোনো নিরাপত্তা থাকে না। এই অন্যায় ও অবিচার থেকেই দেখা দেয় শ্রমিক অসন্তোষ। শিল্পে, কৃষিতে ও কলকারখানায় অশান্তি এবং পরিণামে ধর্মঘট। বিশেষ করে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মালিক পক্ষের সঙ্গে কোন সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব না হলে শ্রমিকরা ধর্মঘটের পথ বেছে নেয়। বাধা হয়েই তখন কাজ বন্ধ করেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালান। 


বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছাত্রসমাজ তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘটের পথ বেছে নেয়। আমাদের দেশে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৭১- এ মুক্তিসংগ্রামে এবং ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্ররা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করেছে। আজকাল নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষ ধর্মঘটকে দাবি আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করছে। কর্মচারী ধর্মঘট, শিক্ষক ধর্মঘট, পরিবহন ধর্মঘট, ডাক্তার ধর্মঘট, সাংবাদিকদের ধর্মঘট ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ধর্মঘটের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়েছে। 

নানা ধরনের ধর্মঘট:

ধর্মঘট নানা ধরনের, যেমন : প্রতীক, অনশন, লাগাতার ইত্যাদি। প্রতীক ধর্মঘট স্বল্পস্থায়ী। একদিন, এমনকি কয়েক ঘণ্টার জন্য তা হতে পারে। এই ধরণের ধর্মঘটের উদ্দেশ্য হল দাবি-দাওয়া সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিকভাবে সচেতন করা, দাবি না মানলে বৃহত্তর আন্দোলনের সম্ভাবনা সম্পর্কে তাঁদের হুঁশিয়ার করা। অনশন ধর্মঘটের পেছনে অহিংসা সত্যাগ্রহের আদর্শ বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল। এই ধরনের ধর্মঘটে আত্মনিপীড়নের মধ্য দিয়ে মানুষের শুভবুদ্ধির কাছে আবেদন পৌঁছে দেবার চেষ্টা থাকে। লাগাতার ধর্মঘটের মেয়াদ সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী। এ ধরনের ধর্মঘট একটানা চলে। অনেক সময় দাবি পূরণ না হওয়া অবধি ধর্মঘটীরা আন্দোলন চালিয়ে যান। কখনও আবার পারস্পরিক রেষারেষি ও সংঘশক্তির অভাবের ফলে মাঝপথেই তা পরিত্যক্ত হয়। এছাড়া মালিকপক্ষ শ্রমিকদের জব্দ করবেন বলে কারখানা বন্ধ করে দেন, ‘লক-আউট’ এবং ‘ক্লোজার’ ঘোষণা করেন। শ্রমিকরা তখন বেকার হয়ে পড়েন, দারুণ অভাব ও দারিদ্র্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়ান। 

ধর্মঘটের তুলনায় হরতালের আওতা অনেক বেশি সম্প্রসারিত। হরতাল সাধারণত সর্বাধিক চাপ সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হরতালের কর্মসূচিতে দোকানপাট, যানবাহন, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কারখানা, অফিস-আদালত ইত্যাদি সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হয়। 

রাজনৈতিক হরতাল:

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনীতিবিদরা ধর্মঘট ও হরতালকে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার বলে মনে করেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে হরতাল একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অস্ত্র। লাগাতার হরতালের মাধ্যমে আমাদের দেশে সরকারকে ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটেছে। পাশাপাশি হরতাল বাংলাদেশের দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের অভিপ্রেত পন্থা হিসেবে নিন্দিত হয়েছে। কথায় কথায় জনসমর্থনহীন হরতাল আহ্বান করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির প্রবণতা সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারার সহায়ক হতে পারে না। অনেক সময় জনসমর্থনহীন হরতাল পালনকারীরা সন্ত্রাস, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমা নিক্ষেপ করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে থাকে। যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। 

হরতালের ক্ষতিকর দিক:

হরতাল নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। একটি হরতাল সফল করার জন্য সংগঠনের কেন্দ্রীয় এবং তৃণমূল পর্যায়ে যে প্রস্তুতির প্রয়োজন তাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। হরতাল মোকাবেলার জন্য সরকারের যে প্রস্তুতি তাতেও অনেক ব্যয় হয়। হরতালকালে প্রায়শই সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ঘটে, কলকারখানায় উৎপাদন অংশিক বা পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে, যোগাযোগ ব্যহত হয়। সব মিলিয়ে জাতীয় অর্থনীতি ও সামাজিক শৃঙ্খলার যে ক্ষতি হয় তা নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকেই হরতালকে একটি ক্ষতিকর রাজনৈতিক অধিকার বলে মনে করে। 

উপসংহার:

আজকাল নানা কারণে ধর্মঘট ও হরতাল আমাদের সমাজজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। তা কতকটা অভিপ্রেত এবঙ কতকটা অনভিপ্রেত তা আলোচনা-সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। ধর্মঘট ও হরতাল আমাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনের এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত বলে তা নিয়ে গভীরভাবে আমাদের ভাবতে হচ্ছে। সব দিক মিলিয়ে দেখলে সন্দেহ থাকে না যে, ধর্মঘট মূলত শ্রমিক-সমাজেরই এক বিশিষ্ট হাতিয়ার। দেশে দেশে কোটি কোটি শ্রমিক ধর্মঘটে শামিল হচ্ছে, তাদের দাবিদাওয়া যতদিন পুঁজিপতিদের আধিপত্য থাকবে, ততদিন ধর্মঘট বন্ধ হবার কোনো আশা নেই, কারণও নেই, কিন্তু নানা কারণে আমাদের দেশে ধর্মঘট নৈরাজ্য সৃষ্টির কাজ করছে। হরতাল এখন সর্বনাশা রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বর্তমান সমাজব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে, প্রতিযোগিতার বাজারে সর্বসম্মতিক্রমে হরতাল পরিহার করা উচিত।