রচনা: ডেঙ্গুজ্বর: কারণ ও প্রতিকার

রচনা: ডেঙ্গুজ্বর: কারণ ও প্রতিকার
Admin June 25, 2024 91

ভূমিকা:

যান্ত্রিক সভ্যতা বিশ্বমানবকে দিয়েছে ভোগসুখের অঢেল প্রাচুর্য। ভোগ্যসম্পদে আর বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে দিয়ে মানুষ হয়েছে সৌভাগ্যগর্বে গর্বিত। কোনো সভ্যতাই মানুষকে দেয় নি অবিমিশ্র সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি ও সুস্থিরতা। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর যান্ত্রিক সভ্যতা আর ব্যতিক্রম নয়। সেও আমাদের জীবনে প্রসারিত করেছে বহুবিধ সংকটের কালোছায়া। তার মধ্যে ভয়াবহ পরিবেশদূষণ অন্যতম। এই পরিবেশদূষণের ফলেই আজকের দিনে আমাদের নোংরা পরিবেশে জন্ম নিয়েছে এক ভয়াবহ আতঙ্কময় জীবাণু বহনকারী ক্ষুদ্র পতঙ্গ এডিস মশা যার দংশনে মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এই ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাবের সারা দেশের মানুষ আজ দুশ্চিন্তিত, প্রতিকারের চিন্তায় উদ্‌ভ্রান্ত, এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কত আলোচনা, কত বৈঠক, কত সমাবেশ। তাই আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে এডিস মশার হাত থেকে তথা ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে পারি তার ব্যবস্থা করতে হবে।

ডেঙ্গুজ্বর কেন হয়?:

ডেঙ্গুজ্বর একটি ডেঙ্গু-ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগ। সাধারণত মানুষের আবাসস্থলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দিনেরবেলায় দংশনকারী Aedes aegypti মশা এসব ভাইরাসের বাহক। কোন কোন অঞ্চলে অন্যান্য প্রজাতি Aedes albopictus, Aedes polynesiensis মশাও সংক্রমণ ঘটায়। রোগীকে দংশনের দুই সপ্তাহ পর মশা সংক্রমণক্ষম হয়ে ওঠে এবং গোটা জীবনই সংক্রমণশীল থাকে।

রোগের লক্ষণ:

১। জ্বর হওয়া : ডেঙ্গুজ্বর ডেঙ্গু-ভাইরাসের সংক্রমণ উপসর্গবিহীন থেকে নানারকমের উপসর্গযুক্ত হতে পারে, এমনকি তাতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সচরাচর দৃষ্ট ডেঙ্গুজ্বর, যাকে প্রায়ই ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু বলা হয়, সেটি একটি তীব্র ধরনের জ্বর যাতে হঠাৎ জ্বর হওয়া ছাড়াও থাকে মাথার সামনে ব্যথা, চক্ষুগোলকে ব্যথা, বমনেচ্ছা, বমি এবং লাল ফুসকুড়ি। প্রায়ই চোখে প্রদাহ এবং মারাত্মক পিঠব্যথা দেখা দেয়। এসব লক্ষণ ৫-৭ দিন স্থায়ী হয় এবং রোগী আরও কিছুদিন ক্লান্তি বোধ করে এবং এরপর সেরে ওঠে।

২। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধানত শিশুদের একটি রোগ। রক্তক্ষরা ডেঙ্গু হলো ডেঙ্গুর একটি মারাত্মক ধরন। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণগুলো বয়স নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই অভিন্ন। এই ডেঙ্গুজ্বরের শুরুতে হঠাৎ দেহের তাপ বেড়ে যায় (৩৮০-৪০০ সে.) এবং ২-৭ দিন পর্যন্ত চলে। এতে মাথা ব্যথা, ক্রমাগত জ্বর, দুর্বলতা এবং অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশীর তীব্র ব্যথা। শ্বাসযন্ত্রের ঊর্ধ্বাংশের সংক্রমণসহ রোগটি হালকাভাবে শুরু হলেও আচমকা শক ও ত্বকের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ ও কান দিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়।

৩। ডেঙ্গু-শক সিনড্রম : এটি রক্তক্ষরা ডেঙ্গুরই আরেকটি রকমফের, তাতে সঙ্কুচিত নাড়িচাপ, নিম্ন রক্তচাপ অথবা সুস্পষ্ট শকসহ রক্তসঞ্চালনের বৈকাল্য তৈরি করে। দেহের বাইরে থেকে যকৃৎ স্পর্শ করা যায় ও নরম হয়ে ওঠে। কদাচিৎ জন্ডিস হয়ে যায়, অব্যাহত পেট ব্যথা, থেকে থেকে বমি, অস্থিরতা বা অবসন্নতা এবং হঠাৎ জ্বর ছেড়ে ঘামসহ শরীর ঠাণ্ডা হওয়া ও দেহ সম্পূর্ণ নেতিয়ে পড়া এই রোগের লক্ষণ।

রোগ সংক্রমণ:

Aedes aegypti মশা জনবসতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকেই বংশবৃদ্ধি করে। এদের লার্ভা বেশিরভাগই পরিত্যক্ত টায়ার, বালতি, ফেলে দেওয়া নারিকেলের খোল, ফুলদানি, ফুলের টবের নিচের থালায় জমে থাকা পানিতে, এমন কি জমে থাকা গাছের গর্তে এবং এ ধরনের অন্যান্য প্রাকৃতিক স্থানে বড় হয়। পূর্ণবয়স্ক মশা সাধারণত ঘরের ভিতর অন্ধকার জায়গায় আলমারি, বিছানা বা খাটের তলায় থাকতে পারে। এই প্রজাতি দিনেরবেলায় বেশি সক্রিয় থাকে, বেশিরভাগ কামড়ের ঘটনা ঘটে সকালের প্রথম দিকে বা বিকালের শেষে। কোন আক্রান্ত লোকের রক্ত খেয়ে থাকলেই মশা সংক্রমিত হয় এবং ১০-১২ দিনের নির্ধারিত উপ্তিকাল যাপনের পর সংক্রমণ ক্ষমতা অর্জন করে। মশা সংক্রমণক্ষম হয়ে ওঠলে লোকের শরীর থেকে রক্ত শোষণের সময় এমনকি ত্বকে শুঁড় ঢুকালেও ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটতে পারে।

ডেঙ্গু বাহক নিয়ন্ত্রণ:

ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ঔষধ বা প্রতিষেধক নেই। দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাই কেবল রোগের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। সাধারণত ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর বিরুদ্ধেই দেহের রোগ প্রতিরোধে সামর্থ্য থাকে, কিন্তু রক্তক্ষরা ডেঙ্গুতে বেশিরভাগ রোগীই মারা যায়। তাই মশার বিরুদ্ধেই নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হওয়া আবশ্যক। বাংলাদেশে ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নেই। বাংলাদেশে কোনো কোনো শহরে মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম থাকলেও এডিস মশার বিরুদ্ধে নয়। এই জাতের মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। এগুলি যেহেতু পানিভরা পাত্রে বৃদ্ধি পায়, তাই যত্রতত্র কীটনাশক ছড়িয়ে কোন সুফল পাওয়া যাবে না। ঘরের চারদিকে স্প্রে করা অথবা খুব সকালে বা সন্ধ্যার শেষে ঘরে বিষ ধোঁয়া বা এরাসোল দিলে দিনেরবেলা দংশনকারী এডিস মশা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

উপসংহার:

মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ সহজসাধ্য নয়। সাধারণত নিয়ন্ত্রণের জন্য সবাইকে মশা বৃদ্ধির অকুস্থল যেমন পরিত্যাক্ত পাত্র, টায়ার, ডাবের খোসা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে এবং বাসস্থানের আশপাশ থেকে জমা পানি নিষ্কাশন করতে হবে। বস্তুত কার্যকর ও টেকসই নিবারণ ব্যবস্থার জন্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অবশ্যই স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্তি আবশ্যক।