রচনা: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য

রচনা: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য
Admin June 28, 2024 289

ভূমিকা:

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি এই বাংলাদেশ। অপরূপা এ দেশের সবুজ বনবনানি, সুবিশাল ম্যানগ্রোভ বনরাজি, নদনদী, শ্যামল পাহাড়, বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত, প্রাচীন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ যুগ যুগ ধরে পৃথিবী বিভিন্ন দেশের ভ্রমণ বিপাসু উৎসাহী মানুষকে আকৃষ্ট করে আসছে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল দেশটি যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মিউজিয়াম। সবুজ শ্যামল প্রকৃতির জন্যে এর প্রশংসা যুগ যুগ ধরে কবিদের বাণীতে উচ্চারিত হয়েছে তাইতো কবি বলেন :

‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য:

বাংলাদেশ প্রকৃতির নন্দনকাননের সৌন্দর্যমণ্ডিত কোনো সার্থক চিত্রশিল্পীর নিখুঁত চিত্রকর্মের সঙ্গে তুলনীয়। ব-দ্বীপ সদৃশ এ বঙ্গভূমির রয়েছে বিচিত্র ভূভাগ এবং সমুদ্র স্তনিত বিস্তীর্ণ উপকূল। সমুদ্র জলপ্রপাত, চা-বাগানের আহামরি দৃশ্য, সবুজ গালিচার মতো শস্য ক্ষেত, মাঠ-প্রান্তর। আর বিশেষ করে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে রূপালি সব ছোটবড়ো নদনদী। এছাড়া আমাদের এই সবুজ শ্যামল বাংলার প্রকৃতি জুড়ে ছয় ঋতুর অপরূপ খেলা চলে সারাটি বছর জুড়ে।

বাংলাদেশের প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যতা:

প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্যের রূপ ছড়িয়ে আছে গোটা দেশ জুড়ে। তবে অঞ্চলভেদে বৈচিত্র্যও আছে। শাল মহুয়ার ঘন বীথি, ঝিলিমিলি ঝিল আর বিশাল বিল প্রকৃতিকে করেছে ঐশ্বর্যশালী ও লাবণ্যময়। পশ্চিম অঞ্চলের অবারিত প্রান্তর, বালুময় পথঘাটে আছে ধূলিধূসর রুক্ষতা। তবে মাঠের পর মাঠ আখের ক্ষেত, আম বাগান ও পানের বরজ আছে। সেখানেও দিগন্ত জুড়ে সবুজ শ্যামলিমা। পূর্বাঞ্চলে নীলাভ পাহাড়ের ঢলে বিছানো চায়ের বাগানগুলো যেন সবুজ সিঁড়ির ধাপ দিয়ে সাজানো। তারই ফাঁকে ফাঁকে ছায়াবীথির বিস্তার। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদীর বুকে ঢলে পড়া সূর্যের আভা রঙের কারুকাজ ফুটিয়ে তোলে। মধুপুর ও ভাওয়াল অঞ্চলের প্রকৃতিতে রয়েছে ভিন্নতর দৃশ্যপট। সেখানে গেরুয়া মাটিতে সারি সারি গজারি গাছের বিস্তার। আর দক্ষিণের উপকূল জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। সেখানে রয়েছে চির সবুজ পাতার টোপর পরা পল্লবঘন তরুবীথি। আর সেখানেই বসতি পেতেছে ডোরাকাটা বাঘ আর চিত্রল হরিণেরা। দক্ষিণের সুনীল সাগরের বুকে ভেসে থাকা দ্বীপাঞ্চলে রয়েছে আর এক ধরনের চিত্র। সেখানে প্রকৃতির দৃশ্যপট তৈরি করেছে তাল-নারকেল-সুপারির বাগান। বেত-শোলা-কেওড়ার বন আর প্রান্তর জোড়া ধানক্ষেত। সেখানে ঘর বেঁধেছে সংগ্রামে দুর্জয় মানুষেরা। জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে তারা বাঁচে আর সমুদ্র শান্ত থাকলে তারা বাঁচে সাগরের সঙ্গে মিতালি করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উপমহাদেশের এ দেশটি তাই মন-মাতানো, দৃষ্টিনন্দন এবং কবি লেখক তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। এর সৌন্দর্যে ভরপুর হয়ে কবি পেয়েছে ভাষা, মানুষ পেয়েছে আশা। পর্যটক চোখ খুলে মন ভরে উপভোগ করে এর সৌন্দর্য, মেটায় অন্তরের তৃষ্ণা। এর অনুপম নৈসর্গিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উপভোগের জন্য বাংলাদেশ যুগে যুগে হাতছানি দিয়েছে কাছের ও দূরের ভ্রমণ-পিপাসুদের। অনেকেই তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় প্রশস্তি গেয়েছেন বাংলাদেশের মনলোভা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের। এমনই একজন পর্যটকের উক্তি :

‘বাংলাদেশে প্রবেশের হাজার দুয়ার খোলা রয়েছে কিন্তু বেরুবার একটিও নেই।’

সমুদ্র সৈকত, লেক ও দ্বীপাঞ্চল:
পৃথিবীর দীর্ঘতম বেলাভূমি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। আর এ কক্সবাজারের কথা বললেই চোখে ভাসে মুক্ত আকাশ। সামনে অবারিত জলরাশি। শ্রভ্র ফেনিল ঢেউ যে কাউকে মুহূর্তে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলে। রয়েছে সাগর মোহনায় নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এছাড়াও রয়েছে সোনাদিয়া দ্বীপ, সাগর কন্যা নিঝুম দ্বীপসহ আরও অনেক দ্বীপের মনলোভা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃশ্যপট। ফয়’স লেকের নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেমন অপরূপ তেমনি মোহনীয়।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুয়াকাটা। প্রকৃতির কোলে অথৈ জলরাশি শুধু কৌতূহল জাগায়। এর সমুদ্রতট থেকে দেখা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য। সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালী করে বেঁচে থাকে এখানকার মানুষ।


বনভূমি ও পাহাড়:

পৃথিবরি সবচেয়ে বড়ো ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া এ বন নানা জীববৈচিত্র্যে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, নানা বৃক্ষরাজিতে শোভিত গভীর রহস্যে ভরা।
পাহাড়িয়া অঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধতর করেছে। এ অঞ্চলটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বান্দরবান অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। ময়মনসিংহের মধুপুর ও গাজীপুরের ভাওয়ালের গড়, কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের বনাঞ্চল যেন অপার সৌন্দর্যের আধার। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া অঞ্চল, গারো পাহাড়ের পাদদেশ ও সিলেটের সবুজ সবুজ ছাওয়া বিস্তীর্ণ চা বাগানসহ সমগ্র পাহাড়িয়া অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ।

পল্লী-প্রকৃতি:


“তুমি যাবে ভাই
যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোট গাঁয়?”

হরিতে-হিরণে, সবুজে-শ্যামলে, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ- যার মূলভিত্তি ‘ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলো’। প্রায় বিরানব্বই হাজার গ্রাম নিয়ে গঠিত এই দেশের শতকরা ৮৫ জন লোক পল্লীগ্রামে বাস করে। পল্লীর সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা রূপ নিয়ে কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল,


‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন
মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন’

নদ-নদী ও হাওড়-বাঁওড়:

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এর নদী-নালা, হাওড়-বাওড়, খাল-বিল সব মিলে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া- এক বিচিত্র রূপের অপূর্ব সমারোহ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, আড়িয়াল খাঁ, কর্নফুলী আর বুড়িগঙ্গা যার বুকে ভেসে থাকা রংবেরঙের পাল তোলা সারিসারি নৌকার অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন রূপ বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও মোহনীয় ও আকর্ষণীয় করে তোলেছে। অপরদিকে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জুড়ে অবস্থিত চলনবিল এবং সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওড়সহ অসংখ্য হাওড়-বাঁওড় এদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বিশিষ্টতা দান করেছে। তাই আজ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।

বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল:

বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চল পলিগঠিত বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল। উর্বর এ সমভূমি অঞ্চলে দৃষ্টিগোচর হয় সবুজের সমারোহ। সবুজ মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় এ যেন সবুজের বিশাল সমুদ্র। শস্যসম্ভবা সবুজ শ্যমলিমা যখন মৃদুমন্দ বাতাসে আলোড়িত হয় তখন মনে হয় সবুজ ঊর্মিমালা বুঝিবা ধেয়ে যাচ্ছে দিগন্তের পানে।

সংস্কৃতি:
হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গড়া এ দেশ। এ দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এর রূপমাধুর্যে যেন একটি স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছে। বাংলা বর্ষবরণ ও বসন্তবরণের মতো অনুষ্ঠানগুলো আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এগুলো রঙ, রূপ ও বৈচিত্রে সমকালীন প্রকৃতির অনুরূপ। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশে এগুলো ভিন্ন ও রোমাঞ্চকর আমেজ সৃষ্টি করে। ফলে সুপ্ত মনের পাতায় পাতায়, মনের অজান্তেই আমরা এঁকে যাই প্রকৃতির ছবি, লিখি কবিতা, গেয়ে উঠি গান। মন হারিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঋতুবৈচিত্র্য:

প্রকৃতির রূপসী কন্যা আমাদের এই বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্তের দেশ। শরৎ আর হেমন্তও আছে। এ ঋতু যায়, আসে অন্য ঋতু। গ্রীষ্মের সন্তাপ, বর্ষার সজলতা, শরতের নীল আকাশ, হেমন্তের সৌরভ আর শীত বসন্তের সৌন্দর্যে আমরা মুদ্ধ হই। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার ঋতুবৈচিত্র্যের মধ্যে চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। বার মাসে ছয় ঋতুর এদেশে প্রতিটি ঋতু তার অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগমন করে এবং নিজের অনাবিল সৌন্দর্য উপহার দিয়ে বিদায় নেয়। সারাটি বছর নব নব রূপের মধ্যে আমাদের বসবাস। প্রকৃতি পাল্টায়। আকাশ রং বদলায়। আমাদের মনের আকাশেও লাগে তার ছোঁয়া। বাংলাদেশের প্রকৃতি যেন বৈচিত্র্যময় মনোলোভা সৌন্দর্যের খনি। এর রৌদ্রময় উজ্জ্বল দিন, স্নিগ্ধ জোৎস্নাময় রাত, দিগন্ত জোড়া ছায়াঘন বন-বনানী, কত না নদীর রূপালি ঢেউয়ের হাসি ইত্যাদির তুলনা নেই। এ দেশের কাজলকালো দিঘির জলে ফুটে থাকা অযুত শাপলার শোভা, মাঠে মাঠে হাওয়ার দোলা, সরষে ফুলের অফুরন্ত সৌন্দর্য আমাদের মুদ্ধ করে। এমনই বিচিত্র ও অপরূপ সৌন্দর্যের আধার আমাদের এই বাংলাদেশ। আর এ জন্যই এ দেশে এত সাধক, কবি, শিল্পী ও কর্মীর এমন অপূর্ব সমাবেশ। এত রূপ আর এত মহিমার প্রকৃতিঘেরা দেশ আর কি কোথাও আছে?

উপসংহার:
স্মরণাতীতকাল থেকেই বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও সম্পদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিযাত্রী, ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের উৎসুক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারা অবাক হয়ে দেখেছে এই পৃথিবীতে এমন একটি দেশ আছে যা ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, সবুজ শ্যামল প্রকৃতিময় আর আছে সুখ-শান্তি সমৃদ্ধির অফুরন্ত ভাণ্ডার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ ধকল সহ্য করতে না পেরে সোনার বাংলার সব সৌন্দর্য প্রতিনিয়ত শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। এ জন্য আমাদেরকে পরিবেশের ব্যাপারে সচেতন ও যত্নবান হতে হবে। চোখ জুড়ানো মন ভুলানো এ দেশ আমার-আপনার গর্ব।