স্বপ্নের ব্যাখ্যা

Admin
November 02, 2024
274
স্বপ্নে রয়েছে আল্লাহর বিস্ময়কর জ্ঞান ও দয়া, যা মুমিনের ঈমানকে বাড়িয়ে দেয়। এটি তাকে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবহিত করে, যা তাকে গণকদের মিথ্যাচারিতা থেকে রক্ষা করে। এতে রয়েছে ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ, মন্দের বিরুদ্ধে সতর্কীকরণ এবং সুসংবাদ ও ভীতিপ্রদর্শন। ইসলামি শরিয়তে স্বপ্নের একটি বড় মর্যাদা রয়েছে। এ উম্মতের জন্য প্রথম কল্যাণ ও জ্যোতি ছিল স্বপ্নের মাধ্যমে। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ওহীর সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন, তা প্রভাত জ্যোতির মতো সুস্পষ্টরূপে সত্যে পরিণত হতো।—সহিহ বুখারি
বদর যুদ্ধের সময় আল্লাহ তাআলা স্বপ্নে তার নবীকে বিজয় দেখিয়েছিলেন। ফলে এটি ছিল মুমিনদের অবিচলতার একটি উপায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ আপনাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন যে, তারা সংখ্যায় কম; যদি আপনাকে দেখাতেন যে, তারা সংখ্যায় বেশি, তবে অবশ্যই তোমরা সাহস হারাতে এবং যুদ্ধবিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন।’—সূরা আনফাল: ৪৩
আল্লাহ তাআলা নবী করিম (সা.)-কে মদিনায় থাকাবস্থায় স্বপ্নে মক্কা বিজয় দেখিয়েছিলেন, এটি ছিল তার জন্য সুসংবাদস্বরূপ। হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যার বিষয়ে খুব গুরুত্ব দিতেন। তাই তো তিনি ফজরের নামাজ আদায় শেষে লোকদের দিকে মুখ করে বসতেন এবং বলতেন, ‘তোমাদের কেউ কি গত রাতে কোনো স্বপ্ন দেখেছ?’—সহিহ বুখারি
স্বপ্ন তিন প্রকার। এক প্রকার সত্য স্বপ্ন, যা ঘটবেই। অন্য দুই প্রকার হয় শয়তানের পক্ষ থেকে অথবা মনের নানাবিধ কল্পনা। হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘স্বপ্ন তিন ধরনের। শুভ স্বপ্ন, আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। আরেক স্বপ্ন হলো শয়তানের পক্ষ থেকে, দুর্ভাবনায় ফেলার জন্য এবং আরেক স্বপ্ন হলো মানুষের মনের কল্পনা।’—সহিহ মুসলিম
শুভ স্বপ্ন মুমিনকে প্রফুল্ল করে এবং তাকে ধোঁকায় ফেলে না। এটিই নবুয়তের অংশবিশেষ। হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের স্বপ্ন নবুয়তের ছিয়াল্লিশ ভাগের এক ভাগ।’—সহিহ বুখারি
সত্য স্বপ্ন নবুয়তের একটি অংশ, আর নবুয়ত হলো ওহীর অন্তর্ভুক্ত। স্বপ্নের ব্যাপারে যে মিথ্যা বলে, বস্তুত সে আল্লাহ যা তাকে দেখাননি তা দেখানোর মিথ্যা দাবি করে। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট মিথ্যা কথার অন্যতম এই যে, মানুষ স্বপ্নে যা দেখে না, তা দেখেছে বলে দাবি করা।’ —সহিহ বুখারি
তার শাস্তি কঠিনতর করার জন্য কিয়ামতের দিন তাকে এমন কিছু করতে নির্দেশ প্রদান করা হবে, যা করতে সে সক্ষম নয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন স্বপ্ন ব্যক্ত করল যা সে দেখেনি, কিয়ামতের দিন তাকে দুটি যবদানার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে আদেশ করা হবে; কিন্তু সে তা কখনোই পারবে না।’ —সহিহ বুখারি
ইবনে হাজম (রহ.) বলেন, ‘কাফেরের স্বপ্নও সত্য হতে পারে, কিন্তু সেটা নবুয়তের অংশবিশেষ নয় অথবা সুসংবাদবাহী বিষয়ের অন্তর্গত হবে না। তবে তা হবে তার জন্য ও অন্যদের জন্য সতর্কবাণী ও উপদেশস্বরূপ।’
দিনের বেলার স্বপ্নও রাতের স্বপ্নের ন্যায় সত্য হতে পারে। ‘একদিন নবী করিম (সা.) উম্মে হারাম বিনতে মিলহান (রা.)-এর বাড়িতে গিয়ে দিনের বেলায় কিছুক্ষণ হালকা ঘুমালেন এবং একটি স্বপ্ন দেখেন। অতঃপর তিনি সেটা উম্মে হারামের কাছে বর্ণনা করেন।’ —সহিহ বুখারি
কেউ পছন্দনীয় কিছু স্বপ্ন দেখলে এজন্য আল্লাহর প্রশংসা করা, খুশি হওয়া ও প্রিয় মানুষের কাছে তা ব্যক্ত করা মুস্তাহাব। তবে হিংসুক ও ষড়যন্ত্রকারী লোকের কাছে এরূপ স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করবে না।
পক্ষান্তরে যে স্বপ্নযোগে অপছন্দনীয় কিছু দেখবে, তার জন্য সুন্নত হলো এ দুঃস্বপ্নের ক্ষতি ও শয়তানের অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা, বামদিকে তিনবার থুতু নিক্ষেপ করা, পার্শ্ব পরিবর্তন করা, কারো সঙ্গে তা ব্যক্ত না করা এবং নফল নামাজে দাঁড়ানো।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা নবী ও ঈমানদারদের জ্ঞানের অংশ। এটি একটি দুর্লভ জ্ঞান যা প্রতিভা ও অর্জনকে একত্রিত করে এবং এমন নেয়ামত যা আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা ফতোয়ার ন্যায়, তাই যে কারো এ বিষয়ে না জেনে কথা বলা জায়েজ নয়।
যে ব্যক্তি তার স্বপ্নের কথা প্রকাশ করতে চায়, সে যেন তা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ জ্ঞানী ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো কাছে প্রকাশ না করে; কেননা প্রত্যেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিই তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নন। অনুরূপভাবে যে শুধু খাবনামার বই দেখে সেও এর সঠিক ব্যাখ্যাকার নয়; কেননা ব্যক্তি, সময় ও স্থানের সঙ্গে স্বপ্নের ব্যাখ্যার নানা অবস্থা জড়িত। ইমাম মালেক (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘যে কেউ কি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পারে?’ তখন উত্তরে বললেন, ‘নবুয়তের সঙ্গে কি তামাশা করা যায়?’
আল্লাহ যাকে স্বপ্নের সুন্দর ব্যাখ্যা করার দক্ষতা দান করেছেন, সে যেন তাকওয়া অবলম্বন করে, লৌকিকতা ও প্রচার পরিহার করে এবং স্বীয় রবের কাছে সাহায্য ও সঠিকতা কামনা করে। আর যেন আত্মতৃপ্তিতে না ভোগে, কেননা এটা নেয়ামত রাজিকে বিনষ্ট করে। সে যেন এ নেয়ামতের জন্য আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে।
মুফতি, স্বপ্নের ব্যাখ্যাকার ও ডাক্তাররা সাধারণ মানুষের গোপনীয়তা ও দোষ-ত্রুটি যতটা অবগত হতে পারেন, তা অন্য কেউ পারে না। কাজেই যা প্রকাশ করা সমীচীন নয়, তাতে তাদের পর্দা ব্যবহার করা উচিত।
সত্য স্বপ্ন নিঃসন্দেহে তা ঘটবেই, চাই তা ব্যাখ্যা করা হোক বা না হোক। আর স্বপ্ন সংঘটিত হওয়ার সময়কাল হলো, তা ওই সময়েও সংঘটিত হতে পারে, আবার তা কমবেশি বিলম্ব করেও হতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ বিন শাদ্দাদ (রহ.) বলেন, ‘হযরত ইউসুফ (আ.)-এর স্বপ্ন চল্লিশ বছর পরে বাস্তবায়িত হয়েছিল। আর এ সময়কাল পর্যন্তই স্বপ্নের প্রতিফলনের মেয়াদ সমাপ্ত হয়।’
মুসলমানের জানা উচিত, আল্লাহ তার জন্য যা ফয়সালা করেন তাই তার জন্য মঙ্গলজনক, চাই তা তাৎক্ষণিকভাবে হোক বা দেরিতে। মানুষের মধ্যে অধিক সত্য স্বপ্নদ্রষ্টা সেই ব্যক্তি, যে জাগ্রত অবস্থায় অধিক সত্যবাদী। নবী করীম (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সত্যভাষী ব্যক্তি সর্বাধিক সত্য স্বপ্নদ্রষ্টা হবে।’ -সহিহ মুসলিম
ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রায়শই তার জাগ্রত অবস্থায় সত্যবাদী হয়, তখন এ অবস্থাটি তার ঘুমের মধ্যেও থাকে; তখন সে সত্য ছাড়া কিছুই দেখে না। আর এটি মিথ্যাবাদী ও প্রতারকের বিপরীতে; কারণ এটি তার হৃদয়কে কলুষিত করে ও তাকে নিষ্প্রভ করে ফেলে; তাই সে বিভ্রান্তি ও দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না।’
সুতরাং কথা বলার ক্ষেত্রে সর্বদা সৎ থাকুন এবং তাকওয়া অবলম্বন করুন; তাহলে উভয় জগতের কল্যাণই লাভ করতে পারবেন।
মনে রাখতে হবে, নবী করীম (সা.)-এর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে ইসলাম ধর্ম পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কাজেই পরবর্তীকালে স্বপ্নের দ্বারা ইসলামের কোনো বিধান সাব্যস্ত হবে না। ইমাম শাতেবী (রহ.) বলেন, ‘স্বপ্নের ফায়দা হলো কেবল সুসংবাদ বা সতর্কীকরণ। পক্ষান্তরে এ থেকে কোনো বিধান সাব্যস্ত করণের ফায়দা গ্রহণ; তা অবশ্যই না।’
আল্লাহতা'আলা আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে শয়তান কর্তৃক তার সাদৃশ্য গ্রহণ থেকে রক্ষা করেছেন, তাই যে ব্যক্তি তাকে স্বপ্নে দেখেছে, সে তাকে বাস্তবেই দেখেছে। এ মর্মে নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমাকে দেখে, সে অবশ্যই আমাকে দেখেছে। কারণ শয়তান আমার রূপ ধারণ করতে পারে না।’ -সহিহ বুখারী
কেউ নবী করীম (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলে এটা প্রমাণ হয় না যে, সে অন্যদের থেকে উত্তম ব্যক্তি। আবার কেউ যদি নবীর সুন্নত ও জীবনীতে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যবহির্ভূত অন্য রূপে তাকে স্বপ্নে দেখে অথবা দেখে যে, তিনি তাকে বাতিল কিছুর আদেশ করছেন; তাহলে বুঝতে হবে যে, এটা অলীক স্বপ্ন। বস্তুত নবী করীম (সা.)-এর অনুসরণেই যাবতীয় কল্যাণ নিহিত।