শবে কদরের ফজিলত ও আমল (লাইলাতুল কদর)

শবে কদরের ফজিলত ও আমল (লাইলাতুল কদর)
Admin March 07, 2024 217
শবে কদর মহান রবের পক্ষ থেকে তাঁর বান্দার জন্য বিশেষ পুরস্কার। ইবাদতের  মোক্ষম এক সময়। স্বল্প সময়ে বান্দা অর্জন করে নেয় অসংখ্য সওয়াব। এ সুবর্ণ সুযোগ আল্লাহ তায়ালা একমাত্র উম্মতে মুহাম্মাদিকেই দান করেছেন। অন্য কোনো নবীর উম্মতকে এ সুযোগ দান করেননি। রমজান মাসের শেষ দশকে বিজোড় রাতে শবে কদরের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাই সবার কর্তব্য, মহিমান্বিত এ রাতের গুরুত্ব অনুধাবন করা ও এর কদর করা।

কোন রাত লায়লাতুল কদর?

আল্লাহ তাআলা এ রাতকে গোপন করে রেখেছেন, যাতে মুসলিম ব্যক্তি রমজানের শেষ দশদিনে অধিক শ্রম ব্যয় করে, বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোয়। আর সেগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাত। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশের বেজোড় রাতগুলোতে লায়লাতুল কদর অনুসন্ধান করো। - (বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

আলেমদের কেউ কেউ বিভিন্ন দলিলের মাধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে বলেছেন, এ রাতগুলোর একেকটায় একেক সময় লায়লাতুল কদর সংঘটিত হয়ে থাকে।(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)


কুরআনে শবে কদরের ফজিলত 


মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এ রাতের নামেই একটি সুরা অবতীর্ণ করেছেন। ফজিলতের জন্য এটাই যথেষ্ট। অন্য কোনো ফজিলত না থাকলেও এ নামটাই এ রজনির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করত। এ সুরায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তা (আল-কুরআন) লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি। হে নবী, আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাস থেকে উত্তম। এ রজনিতে ফেরেশতারা ও রুহ (জিবরাঈল আ.) তার রবের নির্দেশে প্রত্যেকটা বিষয়ের জন্য অবতীর্ণ হন। সালাম বর্ষিত হয় বান্দাদের ওপর এবং তা ফজরে উদিত হওয়া পর্যন্ত থাকে’ (সুরা কদর)। এই সুরায় শবে কদরের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে যে, এই মহামান্বিত রজনিতে পবিত্র ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এই রজনিকে হাজার মাসের চেয়েও বেশি শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। হাজার মাস বলে আধিক্য বোঝানো হয়েছে। কারণ তৎকালীন সময়ে আরবরা হাজার সংখ্যাকেই বড় সংখ্যা মনে করত।

সুরা কদরের শানে নুজুল


একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) বনি ইসরাইলের  একজন আবেদের কথা আলোচনা করছিলেন, যিনি এক হাজার মাস ধরে দিনের বেলা রোজা রাখতেন এবং রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করতেন। এ কথা শুনে সাহাবারা খুব নিরাশ হয়ে পড়লেন। তারা বললেন, আমাদের বয়স পূর্বের উম্মতদের তুলনায় নিতান্তই স্বল্প। আমরা কীভাবে তাদের মতো এত নেক আমল করে সওয়াব অর্জন করব। এ প্রেক্ষিতে এ সুরাটি অবতীর্ণ হয়, যাতে আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মাদির শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেন। এ রাতে যে ব্যক্তি নির্ঘুম থেকে ইবাদত-বন্দেগি করবে, সে ৮৩ বছর ৪ মাসের বেশি সময় ধরে মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির সওয়াব লাভ করবে (বুখারি ও মুসলিম)। 


হাদিসে শবে কদরের ফজিলত (লাইলাতুল কদর কী)


আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াব লাভের আশায় সওম পালন করে তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’ (বুখারি)। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর কতিপয় সাহাবিকে স্বপ্নের মাধ্যমে রমজানের শেষের সাত রাতে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়। এটা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমাকেও তোমাদের স্বপ্নের অনুরূপ দেখানো হয়েছে (তোমাদের দেখা ও আমার দেখা) শেষ সাত দিনের ক্ষেত্রে মিলে গেছে। অতএব যে ব্যক্তি এর সন্ধান-প্রত্যাশী, সে যেন শেষ সাত রাতে সন্ধান করে।’ (মুসলিম : ১১৬৫)

শবে কদরের আলামত
যে রাতটি লাইলাতুল কদর হবে তা চেনার কিছু আলামত হাদিসে বর্ণিত আছে। অন্যতম হচ্ছে, রাতটি রমজানের শেষ দশকে হবে। রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি)

রমজানের ২৭তম রজনি লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। উবাই ইবনে কাব বলেন, ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসুল (সা.) আমাদের যে রজনিকে কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা হলো রমজানের ২৭তম রাত’ (মুসলিম)। আরও কিছু বিষয় জানা যায়, যেমন-রাতটি নাতিশীতোষ্ণ হবে, মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে, সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে, সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। (সহিহ ইবনে খুজাইমা : ২১৯০)

শবে কদরের আমল


আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা মাহে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো’ (বুখারি : ২০১৭)। যেহেতু ইতিকাফকারীরা রমজানের শেষ দশকে মসজিদেই অবস্থান করেন এবং সর্বদা আল্লাহর ধ্যানে নিজেদের মগ্ন রাখেন, নিয়োজিত রাখেন নিজেদের আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে; বিধায় আশা করা যায়, তারা শবে কদর পেয়ে যাবেন। এই মহান বরকতময় রাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগি ও তওবা-ইস্তিগফারে রত থাকা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য।

ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো নামাজ। এরপর কুরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল ও তওবা-ইস্তিগফার। শবে কদরে ফেরেশতারা দুনিয়ায় আসেন এবং ইবাদতরত বান্দাদের জন্য দোয়া করেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, ‘শবে কদরে হজরত জিবরাঈল (আ.) একদল ফেরেশতাসহ অবতীর্ণ হন এবং দাঁড়িয়ে বা বসে আল্লাহকে স্মরণরত প্রত্যেক বান্দার জন্য দোয়া করেন।’ (মেশকাত)

শবে কদরে ইবাদতের ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি শবে কদরের পূর্ণ ঈমান-বিশ্বাস ও সওয়াবের নিয়তে কিয়াম করে (অর্থাৎ নামাজে রত থাকে) তার অতীতের সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়’(বুখারি ও মুসলিম)। আল্লাহ তায়ালা আমাদের মহিমান্বিত এ রজনির ফজিলত জেনে আমল করার তওফিক দান করুন।

সুতরাং লাইলাতুল কদর পেলে এ আমল ও দোয়া রাত অতিবাহিত করা জরুরি। তা হলো-

১. নফল নামাজ পড়া। 

২. মসজিদে ঢুকেই ২ রাকাত (দুখুলিল মাসজিদ) নামাজ পড়া।

৩. দুই দুই রাকাত করে (মাগরিবের পর ৬ রাকাত) আউওয়াবিনের নামাজ পড়া।

৪. রাতে তারাবির নামাজ পড়া।

৫. শেষ রাতে সাহরির আগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া।

৬. সম্ভব হলে সালাতুত তাসবিহ পড়া।

৬. সম্ভব হলে তাওবার নামাজ পড়া।

৭. সম্ভব হলে সালাতুল হাজাত পড়া।

৮. সম্ভব হলে সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল নামাজ বেশি বেশি পড়া।

৯. কুরআন তেলাওয়াত করা। সুরা কদর, সুরা দুখান, সুরা মুয্যাম্মিল, সুরা মুদ্দাসির, সুরা ইয়াসিন, সুরা ত্বহা, সুরা আর-রাহমান, সুরা ওয়াকিয়া, সুরা মুলক, সুরা কুরাইশ এবং ৪ কুল পড়া।

১০. দরূদ শরিফ পড়া।

১১. তাওবাহ-ইসতেগফার পড়া। সাইয়্যেদুল ইসতেগফার পড়া।

১১. জিকির-আজকার করা।

১২. কুরআন-সুন্নায় বর্ণিত দোয়াপড়া।

১৩. পরিবার পরিজন, বাবা-মা ও মৃতদের জন্য দোয়া করা, কবর জেয়ারত করা।

১৪. বেশি বেশি দান-সদকা করা।