রচনা: নারীর ক্ষমতায়ন

রচনা: নারীর ক্ষমতায়ন
Admin July 14, 2024 76

ভূমিকা:

একবিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্ব যে বিষয়গুলো আলোচনার ঝড় তুলেছে নারীর ক্ষমতায়ন এর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে নারীর যে মানবেতর অবস্থান কেবল তা থেকে মুক্তিই নয়, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রিক যে- কোনো ধরনের সমস্যা সমাধান ও নীতি নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণকে অন্যতম অপরিহার্য বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।


ক্ষমতায়ন কী?:

‘ক্ষমতায়ন’ শব্দটি তুলনামূলকভাবে নতুন। ক্ষমতায়ন বলতে মূলত বোঝায় নারীর স্বাধীনতা ও সকল ক্ষেত্রে অধিকার প্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। ক্ষমতা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ- বস্তুগত, মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ। নারীর ক্ষমতায়নের অর্থই হলো, সমাজের প্রতিটি স্তরে এমন একটি সুস্থ পরিবেশ থাকবে যেখানে নারী আপন মহিমায় স্বাধীন ও মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠবে; নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে বস্তুগত, মানবিক ও জ্ঞান সম্পদের উপর। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারীর শিক্ষা প্রসার এবং দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার তাগিদ দিয়েছেন। নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী সুফিয়া কামালও নারীর বন্ধনমুক্তি ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।


নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য:

শিশুকাল থেকে নারীর ভেতর বপন করা হয় নীচতার এক বীজ। এর জন্যে অনেকখানি দায়ি পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ, ধর্মীয় গোঁড়ামি। ক্ষমতায়নের লক্ষ্যই হলো পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ ও অধস্তনতার অনুশীলনকে রূপান্তর করা। একমাত্র সম-অংশীদারিত্বেই ক্ষমতায়নের ভিত্তি প্রস্তুত হয়। নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য নির্যাতক ও শোষকের অবস্থান থেকে পুরুষকে মুক্ত করা। বিদ্যমান সমাজে পুরুষের দায়িত্বের পাশাপাশি নারীর দায়িত্ব প্রতিষ্ঠা, পুরুষের অধিকারের পাশাপাশি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা। সম অধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তিতে পুরুষরা গৃহস্থালি ও সন্তান লালন-পালনে সমানভাবে অংশগ্রহণ করবে, পাশাপাশি নারীরাও পুরুষের দায়িত্ব পালনে সমানভাবে অংশ নেবে। ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত কায়রো সম্মেলনে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিকেই বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ১৭৯টি দেশের অংশগ্রহণে ১১৫ পৃষ্ঠার একটি প্রস্তাবনায় সাম্য, ন্যায়বিচার, সন্তান ধারণের প্রশ্নে নারীর ইচ্ছার প্রাধান্য, নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রভৃতি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে প্রতিবন্ধকতা:

দু-একজন নারী সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা মুক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেই নারীর ক্ষমতায়ন হয় না। নারীর ক্ষমতায়ন দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগ যে নারী তাদের সঠিক ক্ষমতায়নকে বোঝায়। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রধান দুটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে :

ক. প্রচলিত মূল্যবোধ ও আইনের সীমাবদ্ধতা:

সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ নারীকে পুরুষের অধস্তন করে রাখে। শিশুবয়স থেকেই নারী দেখে সমাজে পুরুষদের প্রভাব। শিশুকাল থেকেই সে আচার-আচরণ, পোশাক, চলাফেরা ও কথা বলার ধরন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্নধর্মী নিয়মের জালে আবদ্ধ হয়ে যায়। পিতৃতন্ত্রের পক্ষে এমন সব মূল্যবোধ তৈরি হয় যা নারীকে ছুড়ে ফেলে দেয় অন্ধকার আবর্তে। নারী শিক্ষার সুযোগ পায় না, স্বাবলম্বী হতে পারে না; সর্বোপরি আর্থিক বা মানসিকভাবে তাকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়।

প্রচলিত আইনও নারীর বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। সংবিধানে নারী-পুরুষের সম অধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ হচ্ছে না। যৌতুক, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতি অপরাধে শাস্তির বিধান থাকলেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় অপরাধী। সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিয়ে, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব- সব ক্ষেত্রেই আইনের কাঠামোগত দুর্বলতায় নারী হয় বঞ্চিত। দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে যে সন্তানকে সে জন্ম দেয়, বড় করে, সে সন্তানের অভিভাবকত্ব পায় না নারী। সম্প্রতি বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নামের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। সম্পত্তির ক্ষেত্রে মুসলিম আইনে নারী পুরুষের অর্ধেক পায়, হিন্দু নারীরা কিছুই পায় না।

খ. পশ্চাৎপদ রক্ষণশীল ধর্মান্ধ মানসিকতা:

সমাজে রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন কিছু লোক নারীকে সর্বক্ষেত্রে অবদমিত করে রাখতে চায়। নারীমুক্তিকে তারা ধর্মের চরম অবমাননা বলে ভাবে। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নিয়মের জালে তারা নারীসমাজকে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। আজও গ্রামবাংলার বহু নারী রক্ষণশীল ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন কিছু লোকের ফতোয়ার শিকার। এটি নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।


প্রচার মাধ্যমগুলোতে নেতিবাচক ভাবে নারীকে উপস্থাপন:

প্রচার মাধ্যমগুলোতে নারীকে সবসময় পুরুষের অধস্তন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বিজ্ঞাপন চিত্রে অহেতুক নারীর উপস্থিতি টেনে আনা হয়। চলচ্চিত্র কিংবা নাটনে নারীকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন শাড়ি কিংবা গয়না ছাড়া নারীদের আর কিছুই চাইবার নেই। গণমাধ্যমে নারীকে হীনভাবে উপস্থাপন করার জন্যে নারীরাও অনেকাংশে দায়ী।

ক. নারীর স্বার্থ রক্ষাকারী আইন প্রবর্তন:


বিয়ে, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তান ধারণে পূর্ণ স্বাধীনতা, সম্পত্তিতে সম অধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রভৃতি বিষয়ে সনাতন আইন পালটে নারী-পুরুষের সমান স্বার্থ রক্ষাকারী আইন প্রবর্তন করতে হবে।

খ. শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ ও রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ:

নারীকে নিজ নিজ অধিকার ও ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্যে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। নারীকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী সতামতের প্রাধান্য দিতে হবে।

গ. প্রচার মাধ্যমগুলোতে নারীকে সম্মানজনকভাবে উপস্থাপন:

প্রচার মাধ্যমে নারীকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা চলবে না। যথাযোগ্য সম্মানের সাথে এবং রুচিসম্মতভাবেই গণমাধ্যমগুলোতে আসবে নারী চরিত্র।


ঘ. নারীর কাজের স্বীকৃতি:

নারীকে তার কাজের যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। সন্তান লালন ও গৃহস্থালি কাজকে কিছুতেই ছোট করে দেখা চলবে না। বরং পুরুষকেও এসব কাজে সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে যাতে নারী-পুরুষ উভয়ই ঘরে-বাইরে সমানভাবে কাজে অংশ নিতে পারে।

ঙ. রক্ষণশীল মানসিকতার পরিবর্তন:

ধর্মকে পুঁজি করে রক্ষণশীলদের যে ফতোয়াবাজি তা বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

উপসংহার:

এঙ্গোলস তাঁর ‘অরিজিন অব দ্যা ফ্যামিলি’ গ্রন্থে বলেছেন, “নারী মুক্তি তখনই সম্ভব যখন নারীরা সমাজের প্রতিটি কমংকাণ্ডে সমগুরুত্ব নিয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।” আর নারীকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে, নারীর উন্নয়নের জন্যে, এক একথায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্যে দরকার সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার অবসান। প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। নারী স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মতামত প্রদানে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে নারীর ক্ষমতায়নে আর কোনো অপশক্তিই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।