রচনা : গণমাধ্যম

রচনা : গণমাধ্যম
Admin July 12, 2024 96

ভূমিকা :

মহাকালের রথের চাকা কখনো থামে না। সে চলে, এগিয়েই চলে। যুগ বদলায়। বদলায় তার জীবনধারা। এককালের লোকশিক্ষার যে প্রসার-প্রয়াস ছিল, তার পরিবর্তন হল। দিকে দিকে শুরু হয়েছে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। মানুষ মেতে উঠেছে অনাবিষ্কৃত জগতের রহস্য সন্ধানে। একে একে মানুষ আয়ত্ত করেছে আনন্দের নানা উপকরণ। নতুন গণমাধ্যম এসে দখল করল পুরনো গণমাধ্যমের জায়গা। বিজ্ঞান মানুষের হাতে তুলে দিল সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র। এগুলোই হল আধুনিক যুগের আধুনিক গণমাধ্যম। গণশিক্ষার উপযোগিতা আজ দেশে দেশে স্বীকৃত এবং ব্যাপৃত। গণশিক্ষার জন্যে চাই গণমাধ্যম; অর্থাৎ এমন ধরনের কিছু উপাদান যা শিক্ষাবিস্তারে বাতাসের মত নিরপেক্ষ, পানির মত সর্বত্রগামী এবং আলোর মত দ্রুত-বিস্তারী। সর্বোপরি জনগণকে প্রভাবান্বিত করার সবচেয়ে বড় শক্তি হল গণমাধ্যম। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানুষ জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ওপর নীর্ভরশীল হয়ে পড়েছে। 

গণমাধ্যম কী :

একই সঙ্গে ব্যাপক সংখ্যক জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমকে গণমাধ্যম বলা হয়। গণমাধ্যমকে জনসংযোগের উপায় হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। বর্তমান বিশ্বে প্রচারিত গণমাধ্যমের মধ্যে জনপ্রিয় হল রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র এবং চলচ্চিত্র। এছাড়া মোবাইল ফোন এবং কম্পিউটার-ইন্টারনেটও গৌণ গণমাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এসব গণমাধ্যম ব্যবহার করে অনেক দূরের মানুষের কাছেও খুব সহজেই বার্তা পৌঁছে দেয়া যায়। অবশ্য গণমাধ্যমের সহায়তায় জনগণের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ সংযোগ সম্ভব নয়। তাই তাৎক্ষণিক মতামতও পাওয়া যায় না। জনগণের ফিডব্যাক পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তবে বিশেষ ব্যবস্থাধীন ক্ষেত্রবিশেষে তাৎক্ষণিক মতামত সংগ্রহের ব্যবস্থা করা যায়। গণমাধ্যম জনগণের বিনোদন মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। গণমাধ্যমে কোনো দেশ, সমাজ, গোষ্ঠীর শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে। ফলে এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশে পৌঁছে যায়।

অতীতের গণমাধ্যম :

অতীত এই দেশের সহৃদয় সমাজই ছিল গণমাধ্যম। কর্মক্লান্ত মানুষের হাতে সমাজই সেদিন তুলে দিত লোকশিক্ষার আনন্দপাত্র। শিক্ষিতদের ছিল অশিক্ষিতদের প্রতি গভীর দরদ। সেই আনন্দযজ্ঞে সেদিন সকলেরই ছিল সাদর আহ্বান। ছিল আত্মিক বন্ধন। যাত্রা, পাঁচালি, কবিগানের আসর বসত। বেহুলা-লখিন্দরের ভাসান গান শুনতে শুনতে চোখের জলে বুক ভাসাত শ্রোতারা। ব্রতকথায়, ছড়ায়, যাত্রা, সারি-জারি-ভাটিয়ালি-বাউল, ধর্মীয় কাহিনীর বিচিত্র ধারা দিকে দিকে প্রবাহিত হয়েছে। অবশেষে এল বিপর্যয়ের দিন। দিন বদলের পালায় জনমনে লালন নতুন দিনের জোয়ার। গড়ে উঠল নতুন নতুন শহর। তার আকর্ষণে ছুটে এল মানুষ। গ্রাম হল উপেক্ষিত। গণশিক্ষার ধারা হল রুদ্ধ। নতুন শিক্ষিতের দল দেশের জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হল। কথকঠাকুরের আসর আর জমল না। কথা-কবিদের দল গেলেন হারিয়ে। পুরাণ কথায় আর মন ভরে না। দিকে দিকে শুরু হল বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। গণমাধ্যমের রূপ গেল পাল্টে। সৃষ্টি হল আধুনিক গণমাধ্যমের জোয়ার। 

আধুনিক গণমাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভূমিকা :

বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের বদৌলতে শিক্ষা-বিস্তারে বিশিষ্ট কয়েকটি ‘ম্যাস মিডিয়া’ বা গণমাধ্যম আমাদের বিশেষ সহায়ক হতে পারে। এসব গণমাধ্যমগুলো হচ্ছে- সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন ও সিনেমা। 

যারা স্বল্পশিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, সংবাদপত্র তাদের শিক্ষা বা জ্ঞানবুদ্ধির পুঁজিকে বাড়াবার শক্তি রাখে। আর রেডিও টেলিভিশন ও সেনেমা-এ তিনটি মাধ্যম দ্বারা সম্পূর্ণ নিরক্ষররাও উপকৃত হতে সক্ষম। তবে চলচ্ছিত্রে দর্শকরা নিজেদের পছন্দ বা অভিরুচি অনুযায়ী ছবি দেখে থাকে। রেডিওতে শ্রোতারা শুনে শিখতে পারে, জানতে পারে অনেক নতুন নতুন বিষয়। বিষয়-নির্ধারণের সুযোগ রেডিওর ক্ষেত্রে আছে। তাই বেশিরভাগ প্রোগ্রাম নির্ধারিত থাকে বলে শ্রোতাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেও বহু বিষয় শুনতে হয়। অন্যদিকে, টেলিভিশনের ক্ষেত্রে শোনার সঙ্গে সঙ্গে দেখারও বিরাট ভূমিকা থাকে বলে শিক্ষার এই গণমাধ্যমটি আজকের দিনে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এককথায়, সংবাদপত্রের শিক্ষা পড়ে পড়ে, রেডিও শুনে শুনে, আর টেলিভিশন ও চলচ্ছিত্রের বেলায় তা দেখে-শুনে। সম্প্রতি ক্যাসেট, রেডিও-প্লেয়ার ইত্যাদিও শিক্ষা-বিস্তারে গণমাধ্যম হিসেবে বিশেষ কাজ করছে।

গণমাধ্যম হিসেবে ও জনমত গঠনে প্রিন্টমিডিয়া বা সংবাদপত্রের ভূমিকা :

সংবাদপত্র চলমান এই পৃথিবীর বিচিত্র ঘটনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা থেকে শুরু করে বিদ্রোহী বিপ্লব, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা প্রভৃতির অজস্র বিষয় সংবাদপত্রের আওতাভুক্ত। কোথায় কোন্ মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হল, নতুন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কে শপথ নিলেন, কোথায় বিশিষ্ট কোন্ মানুষ পরলোকগমন করলেন, কোন্ বিজ্ঞানী নতুন আবিষ্কার করে রাতারাতি বিশ্ববিখ্যাত হলেন, কোথায় চির-তুষারাচ্ছন্ন দূরধিগম্য পর্বত-চূড়ায় কোন অভিযাত্রীর পদচিহ্ন অঙ্কিত হল, কোথায় গমন কোন্ অরণ্যে প্রাগৈতিহাসিক কোন্ প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল-সংবাদপত্র থেকে আমরা সব খবর জানতে পারি। এছাড়া, খেলাধুলা, আইন-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য, খুন-জখম, চুরি-ডাকাতি, আমোদ-প্রমোদ, ধর্মকর্ম, শেয়ার মার্কেট, বাজার-দর, কর্মখালি, টেন্ডার-বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদির খবরও সংবাদপত্র সযত্নে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে। তবে প্রিন্টমিডিয়া অর্থাৎ দৈনিক সংবাদপত্র, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা পড়ার জন্য যেহেতু একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজন এ জন্য শিক্ষার সঙ্গে প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশে এখনও প্রিন্ট মিডিয়ার পাঠক/গ্রাহকের সংখ্যা সবচেয়ে কম। মাত্র ২৫.৮ ভাগ মানুষ সংবাদপত্র এবং প্রায় ৮ ভাগ মানুষ ম্যাগাজিন পড়েন।

জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা :

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রকৃত ক্ষমতা থাকে জনগণের হাতে। ফলে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও ভূমিকা জাতীয় অগ্রগতির পক্ষে কতটা সহায়ক এবং কতটা জনস্বার্থের পরিপূরক তা নিয়ে জনগণের মধ্যে অনেক সময় দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ক্ষমতাসীনরা সবসময় তাদের পদক্ষেপকে জোর গলায় ইতিবাচক বলে প্রচার করে এবং বিরোধীরা তাকে একেবারেই প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সংবাদপত্র উভয় পক্ষের মতামত, যুক্তি ও তথ্যানির্ভর আলোচনা প্রকাশ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজেদের অভিমত গঠন করতে পারে। সংবাদপত্রের পাতায় জ্ঞানীগুণী বিশেষজ্ঞদের লেখা প্রবন্ধ ও অভিমত, সম্পাদকীয়, চিঠিপত্র, কলাম লেখকদের তর্কবিতর্ক, যুক্তিপ্রদান ও যুক্তিখণ্ডন ইত্যাদি জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশে জাতয় নির্বাচন, দুর্নীতি দমন, সন্ত্রাস দমন, সড়ক দুর্ঘটনা, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ও প্রতিকার, পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে জনমত গঠনে সংবাদপত্র অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। অবশ্য কখনো কখনো কোনো কোনো সংবাদপত্র বিশেষ গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থে জনমতকে তাদের পক্ষে টানার জন্য সঙ্কীর্ণ উদ্দেশ্যপূর্ণ নানারকম প্রচারণার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু পাঠকসমাজ সচেতন হলে শেষ পর্যন্ত এসব সংবাদপত্রের অপপ্রচারের চেষ্টা ও হীন উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না। 

শিক্ষা-বিস্তারে ও জনমত গঠনে রেডিও বা বেতারের ভূমিকা :

শিক্ষা-বিস্তারে রেডিও আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যার্থীরা শিক্ষালাভ করে উপকৃত হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের পঠন-পাঠনে সরাসরি কাজে লাগে এমন সব অনুষ্ঠান প্রায়ই রেডিও থেকে প্রচারিত হতে শোনা যায়। বিদ্যার্থীদের বয়স ও চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে এসব অনুষ্ঠানকে বহুলাংশে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। এছাড়া, নিরক্ষরদের মধ্যে শিক্ষা-বিস্তারে রেডিও বিশেষ সহায়ক হতে পারে। নিরক্ষরদের বয়স, জীবিকা ও মন-মানসিকতার দিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করলে সমাজ নানাদিক দিয়ে লাভবান হতে পারে। বর্তমানে আমাদের দেশে শিশুতোষ অনুষ্ঠানগুলো আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে ‘রেডিও টুডে’, ’রেডিও ফুর্তি’ বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। তবে তাদের বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে ‘বাংরেজি উপস্থাপন’ -এর কায়দা -কৌশল নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। এ দুটি মাধ্যমে শুধু বিনোদণমূলক অনুষ্ঠান, বিশেষভাবে হিন্দি, ইংরেজি, বাংলাসহ নানা ধরনের গান বাজিয়ে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করার বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। যা সমাজের কোনো উপকারে আসে না। কারণ- 

গণমাধ্যম হিসেবে রেডিওর ভূমিকা ও বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একটি মাত্র বেতার যন্ত্রই একটা ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে নাড়া দিতে সক্ষম। ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে বিবিসি বেতার অনুষ্ঠান শুনার জন্য ‘হাটে’র বদলে হয়ে গিয়েছিল ‘বিবিসির হাট’। ওই হাটের একটি দোকানই এই প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। বেতারযন্ত্রের শক্তিশালী ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ১৯৭১ সনে দেখেছিল ও বুঝেছিল। এক অসাধারণ আবেগ মিশ্রিত চাহিদা সৃষ্টি করেছিল একটি ক্ষুদ্র গ্রাম সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্র বেতার যন্ত্র। সেক্ষেত্রে বেতার যন্ত্র শুধুই বেতার যন্ত্র নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল প্রেরকের বার্তা, গ্রাহকের অনুধাবন, গ্রাহক বা সাধারণ মানুষের আলোচনা ও উদ্দীপনা। এর মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল জনমত। মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের চেতনাকে করেছিল উজ্জীবিত। 

রেডিও বাংলাদেশের সবচেয়ে সহজলভ্য গণমাধ্যম। দামে অত্যন্ত সস্তা। সর্বনিম্ন একশত টাকায় একটি রেডিও পাওয়া যায়। রেডিও এমন একটি গণমাধ্যম যা যে কোনো পেশার মানুষ শুনতে পারে। রেডিও শোনার জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন নেই। রেডিওর অনুষ্ঠান এমনভাবে করা হয় যাতে যে কোন স্তরের মানুষ রেডিও থেকে তথ্য পেতে পারে এবং বিনোদন উপভোগ করতে পারে। নানা ধরনের পেশা ও কর্মে, বিশেষভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গণমাধ্যম হিসেবে রেডিওর ভূমিকা গরুত্বপূর্ণ। বৃক্ষরোপণ, মাছ চাষ, উন্নত জাতের হাঁস মুরগী ও গবাদি পশু পালন, ছোট সংসার গঠন, কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে জনগণ রেডিও শুনে বেশি উদ্বুদ্ধ হয়েছে। এ ধরনের অনুষ্ঠানের মধ্যে 'দেশ আমার মাটি আমার’, ‘বৃক্ষ রোপণ’, ’সুযোগ চাই মানুষ হব' (শ্লোগান) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রেডিও গণযোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ২০০২ সালে জাতীয় মিডিয়া সার্ভে দেখা গেছে, শতকরা ৩০.৪ ভাগ রেডিও শোনেন। 

শিক্ষা-বিস্তারে ও জনমত গঠনে টেলিভিশনের ভূমিকা :

টেলিভিশনের মাধ্যমে মানুষ চিত্ত-বিনোদনের উপকরণ ছাড়া শিক্ষার সুযোগও পেয়ে থাকে। এতে প্রচারিত হয় নাচ, গান, বাজনা, বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার, নাটক, যাত্রা, সিনেমা ইত্যাদি। খেলাধুলা ও উৎসব-অনুষ্ঠানের প্রচারকে ঘিরেও দেশে দেশে এর জনপ্রিয়তা। ও বস্তুটির সঙ্গে চলমান বাস্তব জীবনের স্পর্শ জড়িয়ে আছে। বলেই আমাদের কাছে এর আকর্ষণ এতো বেশি। বস্তুত, এর সাহায্যে আমাদের তিক্ত সময়গুলো আনন্দের হয়ে ওঠে। এছাড়া, এর মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বহু বিচিত্র দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ পাই আমরা। কত অনুপম প্রাকৃতিক দৃশ্য, মানুষের কত মহিমাময় কীর্তি, শ্রেষ্ঠ মানুষের বাণী ও জীবন-সাধনার কত বিচিত্র পরিচয় টেলিভিশন আমাদের সামনে তুলে ধরে। উপরন্তু জাতীয়জীবনে সংহতি প্রতিষ্ঠায়, সমাজ জীবনের স্বাস্থ্য রক্ষায়, বিজ্ঞান-শিক্ষায়, সাহিত্য-চর্চায়, ধর্মীয় ও দার্শনিক মতবাদ প্রচারে শিক্ষা-বিস্তারে টেলিভিশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন যাবৎ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিরাট অবদান।

আমরা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আরো নানাবিধ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় কর থাকি। কোথায় কোন্ তুষারধবল দূরধিগম্য পর্বত-শিখর, সভ্য সমাজ থেকে বহুদূরে চিররহস্যে আবৃত গহন-গভীর অরণ্য, শ্বাপদসংকুল, ভয়ঙ্কর প্রমত্তা নদী, নিঃশব্দ মেরুপ্রদেশ, তপ্ত-ধূসর বালুকাস্তীর্ণ মরুভূমি, কোলাহলমুখর জনপদ -চলচ্চিত্রের কৌশলে আমরা প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করে থাকি। এছাড়া, ঐতিহাসিক স্মৃতিজড়িত কত অপরূপ সৌধ, কত বিস্ময়কর মানুষের কীর্তি ও মহিমার কত বিচিত্র নিদর্শন আমরা প্রত্যক্ষ করে বিস্ময়াভিভূত হই। প্রকৃতি ও জীব জগতের তথ্য-চিত্রগুলো শিক্ষার এক বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে আমাদের কাছে চিহ্নিত। ২০০২ সালের জাতীয় মিডিয়া সার্ভে থেকে দেখা যায় দর্শকদের সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৮৫ সালে সিনেমায় দর্শকের হার ছিল ১২ ভাগ, ১৯৮৮ সালে ছিল ১৭ ভাগ এবং ২০০২ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ ভাগে। বর্তমানেতো আরো কমে গেছে। 

সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের প্রভাব : 

(১) বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে গণমাধ্যমের প্রচার বৃদ্ধির ফলে, বিশেষভাবে বিদেশি গণমাধ্যমের প্রভাবে গ্রামীণ জীবনে চিরায়ত লোকজ ও গ্রামীণ সংস্কৃতি ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকজ পালা, পার্বণ, যাত্রা, জারি-সারি প্রায় বিলুপ্ত। 

(২) গণমাধ্যম মানুষের মনোভাব ও অভিরুচিকে প্রভাবিত করে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব তরুণ-তরুণীর মাঝে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় এবং এর প্রভাব পড়েছে পারিবারিক আচার-আচরণে, সামাজিক চালচলনে, কথা-বার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও ফাস্টফুডের ক্ষেত্রে। আজকাল তো আমাদের সমাজে ফাস্টফুডের একটা কালচারই গড়ে ওঠেছে। এমনকি ভাষার ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করছে। কথা-বার্তায় নিজের অজান্তে চলে আসছে হিন্দি ভাষা, বাংরেজি ভাষা (ভুল করে বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে যে ভাষা বলা হচ্ছে)। 

(৩) গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন সত্যিকার অর্থে এ সময়কালে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাধ্যম। টিভি দর্শনে বিষ ও অমৃত দুটোই রয়েছে। নারী হয়েছে সৌন্দর্য সচেতন, বিজ্ঞাপনের ভাষা বাজারকে করেছে প্রভাবিত। উন্নয়ন সম্পাদিত চিন্তা ভাবনা ও মতাদর্শ সাধারণ দর্শকের দোড়গোড়ায় এসেছে। নাটক ও সিরিয়াল মানবিক সম্পর্কের বহুরূপ ও রসকে উপস্থাপন করছে। ইউনিসেফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশীয় মেয়ে শিশুদের প্রতি যত্নবান হতে মিনা কার্টুন গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গ্রামের মানুষ মিনার মাঝে খুঁজে পায় তার ঘরের বা প্রতিবেশীর বালিকা কণ্যার জীবনচিত্র। এভাবে বালিকাদের শিক্ষার প্রতি অভিভাবকরা মনোযোগী হয়। মিনার এ উদাহরণ থেকে প্রমাণিত হয় যে, গণমাধ্যম মানুষের মাঝে আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষা ও জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

গণমাধ্যমের বিরূপ প্রভাব :

গণমাধ্যমের মধ্যে দৃশ্য মাধ্যম খুবই শক্তিশালী মাধ্যম। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেখানে নিরক্ষর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অজ্ঞতা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ব্যাপকভাবে পরিদৃষ্টমান সেখানে দৃশ্যমাধ্যম শিক্ষামূলক না হয়ে ব্যাপকভাবে বিনোদনমূলক। বিশেষ করে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো অত্যন্ত বিনোদন ও প্রচারধর্মী। সমাজে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। 

অবক্ষয়ে চলচ্চিত্রের প্রভাব :

সিনেমার চটুল কাহিনীতে, নাচে-গানে, চলনে-বলনে, পোশাকে-আশাকে মার্জিত রুচির অভাব। সিনেমার উদ্ভট কাহিনীকে তারা অনেক সময় বাস্তব জীবন বলে ভুল করে। সেই অবাস্তব জীবন-মরীচিকার পেছনে ছুটে ছুটে তারা ক্লান্ত হয়। নিঃশেষিত হয় প্রাণশক্তি। পোশাক আশাকের অন্ধ অনুকরণে প্রকট হয় হৃদয়ের অন্তঃসারশূন্যতা। বাস্তবের রূঢ় কঠিন আঘাতে তাদের সেই স্বপ্নের পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে যায়। দুঃসহ বেদনা আর সীমাহীন দীর্ঘশ্বাসে ভরে ওঠে সেই জীবন। অধকাংশ ছায়াছবিতেই খুন-জখম, রাহাজানি-ডাকাতি, শালীনতা-বার্জিত নাচগান, নায়ক-নায়িকার উদ্দম প্রণয়চিত্র। তরুণ মনেও এর দীর্ঘ বিস্তার ছায়া। 

টিলিভিশনের প্রভাব :

টেলিভিশন আধুনিক বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার। বর্তমানে এ টেলিভিশনের সাথে ডিশ অ্যান্টেনা সংযোগ হয়ে আমাদের ঘরে এসে গেছে বিজাতীয় সংস্কৃতি। যা আমাদের সমাজব্যবস্থার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। ফলে এসব সস্তা-বিনোদনে আকৃষ্ট হয়ে আমাদের যুবসমাজ অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। 

পত্র-পত্রিকার প্রভাব :

সংবাদপত্র একটি শক্তিশালী গণযোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু আমাদের দেশে এমন কিছু পত্র-পত্রিকা আছে যা আমাদের সুস্থ জ্ঞানকে অসুস্থ করে তোলে। উদ্ভট নগ্ন-ছবি ও অশ্লীল আজগুবি কল্পকাহিনী এমনভাবে পরিবেশিত হয় যা বিদেশি অপসংস্কৃতিকেও হার মানায়। এসব নগ্ন ছবি দেখে এবং কুরুচিপূর্ণ কাহিনী পাঠ করে যুব সম্প্রদায় এগিয়ে যায় ধ্বংসাত্মক অবক্ষয়ের দিকে। 

আমাদের করণীয় : 

(১) সিনেমা সাংস্কৃতিক বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে সিনেমার দর্শক প্রচুর। সিনেমায় যাতে অশালীণ ও উগ্র পোষাক ব্যবহৃত না হয় তা প্রতি কর্তৃপক্ষের (ফিল্ম সেন্সর বোর্ড) নজর রাখা উচিত। 

(২) মানুষের সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নে ও সভ্যতা বিকাশে গণমাধ্যম প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। ফলে গণমাধ্যমে মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তনের বিষয়গুলো বেশি বেশি প্রচার হওয়া উচিত। 

(৩) আমাদের টিভি মিডিয়ার নিজস্ব সংস্কৃতির উজ্জ্বল দিকগুলোকে আরো উজ্জ্বল করে তোলা দরকার। অনুকরণ নয়, অনুসরণ করে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ করতে হবে। 

উপসংহার :

বর্তমানে বিজ্ঞান-বিদ্যার অগ্রগতির সাথে সাথে শিক্ষা-বিস্তারে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা ক্রমেই বিশেষ অর্থবহ হয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে শিক্ষাসহ জাতীয় অগ্রগতিতে ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে গণমাধ্যম আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনস করবে -এটাই আমাদের প্রত্যাশা।