রচনা : বাংলাদেশের লোকসাহিত্য

রচনা : বাংলাদেশের লোকসাহিত্য
Admin July 10, 2024 99

ভূমিকা :

লোকসাহিত্য আবহমান বাঙালির সৃজন-লালনের পরিচয়বহ মৌখিক সাহিত্য। তাতে ধরা পড়ে শাশ্বতকালের বাঙালি জনজীবনের অন্তরস্পন্দন, কর্মপ্রবাহের রূপাভাস। চিরায়ত বাংলার লোকসাহিত্যের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বহন করছে আমাদের বাংলাদেশ। এর প্রতিটি অঞ্চলই লোকসাহিত্যের বিচিত্র ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ। তাই অনেক বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত ও লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশকে লোকসাহিত্যের এক অগ্রগণ্য পীঠস্থানের মর্যাদা দিয়ে আসছেন।

লোকসাহিত্যের সংজ্ঞা :

গ্রাম বাংলার সহজ-সরল সাধারণ মানুষের সৃজন ও লালনে গড়ে ওঠা মৌখিক সাহিত্যই হচ্ছে লোকসাহিত্য। সৃজন-বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে লোকসাহিত্য সামাজিক সৃষ্টি, কারণ কালপরম্পরায় বহুজনের সংযোজন, সংশোধন ও পরিমার্জনায় গড়ে ওঠে লোকসাহিত্য। এই বিচারে লোকসাহিত্য হলে- ‘collective creation of the folk.’ লোকসাহিত্যের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো- এর সৃষ্টি যেমন লোকের মুখে মুখে তেমনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এর সম্প্রচার ঘটেছে শ্রুতি পরম্পরায় ও মুখে মুখে। এজন্যে লোকসাহিত্য মৌখিক সাহিত্য- Folk literature simply literature transmitted ‘orally’.

লোকসাহিত্যের শাখা-প্রশাখা :

বিষয় ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের লোকসাহিত্যও নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। তবে মোটামুটিভাবে এগুলোকে ছয়টি সাধারণ শাখায় ভাগ করা যায়। এগুলো হলো : ক. গদ্য আখ্যায়িকা, খ. পদ্য আখ্যায়িকা, গ. লোকসংগীত, ঘ. ছড়া, ঙ. প্রবাদ ও লোকনিরুক্তি, চ. ধাঁধা। এগুলো আবার নানা প্রশাখায় বিভক্ত। ফলে এগুলো যেমন বহুধা বৈচিত্র্যময় তেমনি ব্যাপক ঐশ্বর্যমণ্ডিত। বিষয়-বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে রস সৃষ্টিতেও বাংলাদেশের লোকসাহিত্য অনুপম সাংস্কৃতিক সম্পদ হয়ে আছে। এগুলো লোকজীবনের বহু বর্ণিল রঙে রাঙানো। এই জনপদের মানুষের যুগ-যুগান্তরের ভাবনা ও আবেগ তাতে পেয়েছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা।

ক. গদ্য আখ্যায়িকা :

গদ্য আখ্যায়িকার মধ্যে পড়ে পুরাকথা (myth), কিংবদন্তি (legend), লোককাহিনী (folk tale)। পুরাকথায় রয়েছে ধর্মভাবের প্রাধান্য। কিংবদন্তিতে পাই আধ্যাত্মিক সাধন কিংবা ঐতিহাসিক চরিত্রের কথা। মহীপালের গীত, ঈসা খাঁর পালা ইত্যাদি কিংবদন্তির উদাহরণ। লোককাহিনী লোকসাহিত্যের অত্যন্ত সমৃদ্ধি ও ব্যঞ্জনাময় শাখা। বাংলার রূপকথা, ব্রতকথা ও উপকথা এই শাখারই আন্তর্গত। রূপকথায় ভিড় করেছে অজানা দেশের অজানা রাজার কাহিনী, ব্রতকথাগুলোয় ঠাঁই পেয়েছে লৌকিক দেবদেবীর পূজোর ব্রত পালন উপলক্ষে দেবতার মাহাত্ম্য কাহিনী আর নানা ধরনের উপদেশমূলক পশু কাহিনীর সমবায়ে গড়ে উঠেছে উপকথা।

খ. পদ্য আখ্যায়িকা :

পদ্য আখ্যায়িকাগুলো গীতিকা, গাথা ও পালাগান নামে পরিচিত। এগুলোর প্রধান ভাগ দুটি : ধর্মীয় আখ্যায়িকা ও লোকায়ত প্রেমের আখ্যায়িকা। ধর্মীয় গীতিকাগুলো উত্তর বাংলার সম্পদ। এগুলো নাথ গীতিকা নামে পরিচিত। সে তুলনায় বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের সেরা সম্পদ হচ্ছে প্রেম-নির্ভর গীতিকাগুলো- যা ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ বা ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ নামে পরিচিত। এই সব গীতিকায় নারীর প্রেমিক সত্তার যে অভাবনীয় মহিমা প্রকাশিত হয়েছে তা অতুলনীয়।

গ. লোকসংগীত :

বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের বিশেষ সম্পদ লোকসংগীত বা লোকগীতি। লোকজ জীবনের রোজনামচা সহজ সুরে অনুরণিত হয় লোকগীতিতে। অফুরন্ত লোকগীতির ভাণ্ডার আমাদের বাংলাদেশ। বাউল গান, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা ইত্যাদি গান সুদীর্ঘকাল ধরে এদেশে লোকসাহিত্যে ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।

ঘ. ছড়া :

ছড়া বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রধান সম্পদ। ছড়ায় কোনো কাহিনী থাকে না। কল্পনার রঙে আঁকা কোনো বর্ণিল চিত্রই তাতে প্রধান হয়ে ওঠে। এজন্যে অবনীন্দ্রনাথ ছড়াকে তুলনা করেছেন ‘ক্যালিডোস্কোপ’-এর সঙ্গে। বাংলাদেশের ছড়া প্রধানত শিশু-মনের কল্পনার রঙে আঁকা, তাতে রয়েছে এক কোমল-মধুর চিরন্তনতার আবেশ। তার আবেদন চিরকালের। যেমন:
ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি আমার বাড়ি এসো।
সেজ নেই, মাদুর নেই, পুঁটুর চোখে বসো-
বাটা ভরে পান দেব গাল ভরে খেয়ো;
খিড়কি দুয়ার খুলে দেব ফুড়ুৎ করে যেয়ো-

ধ্বনিময়তা ও বর্ণিল চিত্রময়তা বাংলাদেশের ছড়ার অনুপম বৈশিষ্ট্য।

ঙ. প্রবাদ :

বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে প্রবাদ ছড়ার সঙ্গে অধিকতর ঘনিষ্ঠ। দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতাজনিত জীবনচর্যা সীমিত পরিসর বাক্যে সামাজিক সত্য হিসেবে প্রবাদের রূপ নেয়। বাংলা প্রবাদ-প্রবচনের জগৎটি ডাক ও খনার বচনে সমৃদ্ধ। বাংলা প্রবাদের মধ্য দিয়ে সেকালের লোকজীবনকে সহজে স্পর্শ করা যায়।

চ. ধাঁধা :

ধাঁধা বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের এমন একটি বিষয় যেখানে লোকজীবনের অভিজ্ঞতা প্রশ্নের আকারে বাণীবদ্ধ হয়েছে। ধাঁধা হলো গ্রামীণ সমাজে সাধারণ মানুষের শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। বিয়ের আসরে, প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে, গ্রাম্য মজলিশে, আমোদ-প্রমোদের উপকরণ হিসেবেও ধাঁধার ভূমিকা ছিল আনন্দের ও কৌতূহলের। ধাঁধা এবং তার উত্তর- এ দুই মিলেই ধাঁধা হয় তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন :
বন থেকে বেরুল টিয়ে
সোনার টোপর মাথায় দিয়ে।
[আনারস]

এ ধরনের ধাঁধায় বাঙালির লোকজীবনের বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।

লোকসাহিত্যের আরোও কিছু দিক :

বাংলা লোকসাহিত্যের উপাদন হিসেবে মঙ্গলকাব্য ও পাঁচালীর ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। এগুলোর মধ্য দিয়ে গীত হয়েছে বাঙালির জনজীবনের প্রেমমধূর অথবা বেদনাবিধুর জীবনকথা। এ ছাড়াও সেকালে লোকশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে যাত্রাগানের প্রচলন ছিল। মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে সৃষ্টি হয়েছে কবিগান, আখড়াই, টপপা ইত্যাদি। রস পরেবেশনে এগুলো তখন পালন করেছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।

উপসংহার :

বাংলাদেশের লোকসাহিত্যে বাঙালির চিরায়ত জীবনধারার রূপবৈচিত্র্য বাঙ্ময় হয়ে আছে। বাঙালির সমাজ-গঠন, জাতিগত উপাদন, সংস্কৃতির বুনিয়াদ, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাসের নানা মালমশলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লোকসাহিত্যের নানা উপাদনের মধ্যে। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য এখনো যেমন আমাদের অনাস্বাদিতপূর্ব সাহিত্য-রস জোগায় তেমনি লোকসাহিত্যের উপাদনকে কাজে লাগিয়ে কালজয়ী যেমন আমাদের অনাস্বাদিতপূর্ব সাহিত্য-রস জোগায় তেমনি লোকসাহিত্যের উপাদানকে কাজে লাগিয়ে কালজয়ী আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টি করাও সম্ভব। আধুনিক কালের হাওয়ায় বাঙালির সমাজ-পরিবেশে নতুনত্বের হাওয়া লেগেছে। যান্ত্রিকতা আমাদের আচ্ছন্ন করছে কিন্তু বাংলার লোকসাহিত্য অকৃত্রিম সরলতা ও মাধুর্যের খনি হয়ে আমাদের সদাই হাতছানি দেয়। তার সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগ এখন আর নেই। তবু ইচ্ছে করলেই রসমাধুর্যে আমরা আপ্লুত হতে পারি।