রচনা : বাংলাদেশের ছোটগল্প

রচনা : বাংলাদেশের ছোটগল্প
Admin July 17, 2024 732
ছোটপ্রাণ ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল
সহস্র বিস্মৃত রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দুচারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
                                    ---রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

ভূমিকা :

গল্প শোনা বা গল্প বলা মানবমনের এক আদিম ইচ্ছা। গুহামানব মাটির বুকে বা পাথরের গায়ে আঁকিবুকি কেটে গল্পের অস্ফুট কাঠামো তৈরি করে তৃপ্তি পেত। সামন্ততান্ত্রিক সম্প্রদায়ের বল্গাহীন জীবনস্রোতে রুচির পিপাসা মেটাতে আগেকার দিনে গল্প তৈরি করা হতো। তখন সেটা ছিল নিছকই খেয়াল। তারপর অবস্থার পরিবর্তন হলো। গল্প শুধু মানুষের বিনোদনের হাতিয়ার হয়ে রইল না। গল্পের মধ্যে মানুষ খুঁজে পেল তার জীবনকে। ইউরোপের প্রায় সমকালেই ছোটগল্পের আসর বসেছে বাংলা সাহিত্যে। তবে সার্থক বাংলা ছোটগল্পের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সমকাল পর্যন্ত। বাংলাদেশের ছোটগল্পের ইতিহাস সময়ের স্বল্পতার মধ্যে সমৃদ্ধির পর্যায়ে অগ্রসর হচ্ছে।

ছোটগল্পের সংজ্ঞা :

আধুনিক গল্পলেখক বিষয়বস্তু, চরিত্রসৃষ্টি, কথোপকথন, পরিবেশ সৃষ্টি, বাণীভঙ্গি প্রভৃতি প্রত্যেকটি বিষয় সম্বন্ধে একান্তভাবে আত্মসচেতন। গল্প আকৃতিতে ছোট হলেই ছোটগল্প হয় না। আকৃতিগত দিক ছাড়াও প্রকৃতিগত এবং মর্মগত অনেক বিভিন্নতা একে উপন্যাস হতে পৃথক শ্রেণিভুক্ত করেছে। E. A. Poe (১৮০৯-৪৯) বলেন, যে গল্প অর্ধ হতে এক বা দু ঘণ্টার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোটগল্প বলে।' H. G. Wells বলেন, “ ছোটগল্প ১০ হতে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়।” আসল কথা এই যে, ছোটগল্প আকারে ছোট হবে বলে এতে জীবনের পূর্ণাবয়ব আলোচনা থাকতে পারে না। জীবনের খণ্ডাংশকে লেখক যখন রসনিবিড় করে ফুটাতে পারেন, তখনই এর সার্থকতা। জীবনের কোনাে একটি বিশেষ মুহূর্ত কোনো বিশেষ পরিবেশের মধ্যে কেমনভাবে লেখকের কাছে প্রত্যক্ষ হয়েছে, এটি তারই রূপায়ণ। ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শ্রীশচন্দ্র দাশ বলেন, 

ছোটগল্পের আরম্ভ ও উপসংহার নাটকীয় হওয়া চাই। সত্য কথা বলিতে কি, কোথায় আরম্ভ হইবে এবং কোথায় সমাপ্তির রেখা টানিতে হইবে, এই শিল্পদৃষ্টি যাহার নাই, তাহার পক্ষে ছোটগল্প লেখা লাঞ্ছনা বই কিছুই নহে।




আধুনিক বাংলা ছোটগল্প :

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তী সময়ে বাংলা ছোটগল্পের এক নতুন প্রবাহ দেখা দিয়েছিল। একদিকে রাশিয়ার বিপ্লব ও অন্যদিকে ধনতন্ত্রী শক্তির রাজ্যগ্রাসী লিপ্সা -এ দুয়ের মধ্যে পড়ে বাঙালি তরুণ হতাশা ও অবিশ্বাসে যেমন দিশাহারা হয়েছে, তেমনি সমাজবাদের আদর্শে তারা অনেকে নতুন পথও খুঁজে পেয়েছে। একই সঙ্গে ফ্রয়েড, ইয়ুং প্রভৃতি দার্শনিকদের অভিনব জীবনদর্শন আমাদের আজন্ম লালিত সংস্কারগুলোকে ভেঙে দিতে চেয়েছে। জন্ম নিল কল্লোলগোষ্ঠী। কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই পুষ্ট হয়েছিল এ শিল্পী সমাবেশ। কল্লোল, কালি-কলম, উত্তরা'র পাতায় তৎকালীন সামাজিক অবক্ষয় স্পষ্ট হয়ে উঠল। এঁদের প্রয়াসে বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্ত আবিষ্কৃত হলো। এ দলে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁদের অন্যতম উপলব্ধি আরেক দিগন্তের সন্ধান দিল এসময়ের আরও কিছু কথাশিল্পীদের মধ্যে, তাদের মধ্যে আছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল, সরোজ রায়চৌধুরী প্রমুখ। ব্যঙ্গবিদ্রুপের জ্বালাও অনুসৃত হলো পরশুরাম, বনফুলের রচনায়।




দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাংলা ছোটগল্পে পালাবদল ঘটাল। বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা, বিবেকহীনতা সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের মূল্যবোধকে বিপর্যস্ত করল, আর তার বলি হলো সামাজিক মানস। সাহিত্যিক শিল্পীদের মন দুঃখদীর্ণ পৃথিবীর নগ্নরূপ দেখে শিউরে উঠল; মুক্তি পেল বাংলা গল্পের অভিনব আধুনিক ধারা। এ প্রবাহের একপ্রান্তে আছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, সমরেশ বসু, সতীনাথ ভাদুড়ী, বিমল কর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ; অন্যপ্রান্তে আছেন আবুল ফজল, শওকত ওসমান, শাহেদ আলী, আবু রুশদ, হাসান আজিজুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ শক্তিমান লেখকগােষ্ঠী। বস্তুত আধুনিক ছোটগল্প যতটা না জীবননির্ভর, তার চেয়ে বেশি শিল্পসচেতন। এ সমাজে ব্যথাবেদনা, দুঃসহ আত্মদহন আমাদের এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়েছে, যেখানে আমরা কোধে ফেটে পড়তে পারি, পারি সৃষ্টির বীণায় নতুন জীবনের সুর ফুটিয়ে তুলতে।


বাংলাদেশের ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য :

বাংলাদেশের জীবনের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে গল্পের বিষয়েও এসেছে বৈচিত্র্য। একদিন বাংলার পল্পিপ্রকৃতি আর মানুষ গল্পে স্থান পেয়েছে। পরবর্তীকালে নগরমুখী মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দবেদনা হয়েছে ছোটগল্পের উপজীব্য। কৃষিভিত্তিক জীবনাচরণে এসেছে শিল্পের প্রভাব। আধুনিক জীবনের নানা সমস্যা এখন চারদিকে প্রকট। ছোটগল্প এসব কোনোকিছু উপেক্ষা করতে পারে না বলে বাংলাদেশের ছোটগল্পের বিষয় বৈচিত্র্য সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিষয় নির্বাচনে এখানকার গল্পকারগণ ব্যতিক্রমধর্মিতার পরিচয় দিয়েছেন। শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র ছোটগল্পে এখন সহজলভ্য। জীবনঘনিষ্ঠতার জন্য এ বৈশিষ্ট্য প্রকাশমান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ফলে জীবনে ও সমাজে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল, তা বাংলাদেশের গল্পকারগণ উপেক্ষা করতে পারে নি। তাই এখানকার কিছু কিছু গল্পে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র রূপায়িত হয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের প্রতিফলন এখানকার ছোটগল্পে সবচেয়ে বেশি। নগরকেন্দ্রিক জীবনের বিভিন্ন দিকও এখানকার গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে।


বাংলাদেশের ছোটগল্প :

বাংলাদেশের ছোটগল্প এক স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী। এখানকার প্রকৃতি ও মানুষ ছোটগল্পে খুব সুন্দরভাবে বিধৃত হয়েছে। জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দবেদনা নিয়েই এখানকার ছোটগল্প। এদেশের ছোটগল্পে একদিকে যেমন গ্রামীণ জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে, অন্যদিকে তেমনি আছে শহরকেন্দ্রিক জীবনের চিত্র। বাংলাদেশের ছোটগল্পকারদের মধ্যে প্রথমেই যাদের নাম করতে হয়, তাঁরা হলেন আবুল মনসুর আহমদ, মবিনউদ্দিন আহমদ, শওকত ওসমান, আবু রুশদ, শাহেদ আলী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, শহীদ আখন্দ, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আবু ইসহাক, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক এবং আরও অনেকে। আবুল মনসুর আহমদ হাস্যরসের গল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর কৃতিত্ব ব্যঙ্গবিদ্রুপাত্মক গল্পরচনাকারী হিসেবে। আয়না’, ফুড কনফারেন্স', আসমানী পর্দা' প্রভৃতি তাঁর গল্পগ্রন্থ।


প্রবীণ গল্পকারদের মধ্যে আরও একজন হলেন মাহবুব-উল-আলম। তাঁর গল্পগ্রন্থের নাম তাজিয়া’ ও ‘পঞঅন্ন'। আবুল ফজল একজন বিশিষ্ট গল্পকার। মাটির পৃথিবী', 'আয়না', মৃতের আত্মহত্যা’ ও ‘শ্রেষ্ঠগল্প তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। আবু জাফর শামসুদ্দিনের গল্পগ্রন্থের নাম জীবন, ‘শেষ রাত্রির তারা’, ‘একজোড়া প্যান্ট ও অন্যান্য রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা’, স্বনির্বাচিত গল্প’, ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ ‘নেংড়ী’ ইত্যাদি। মবিনউদ্দিন আহমদ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ভাঙ্গা বন্দর’ ও ‘হােসেন বাড়ীর বৌ’ গল্পগ্রন্থ লিখে। মুসলমান সমাজ জীবনের কথা তার গল্পে রূপায়িত হয়েছে। শওকত ওসমান একজন খ্যাতিমান কথাশিল্পী। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প’, সাবেক কাহিনী’, ‘পিজরাপােল’, ‘ওটেন সাহেবের বাংলো’, ‘প্রস্তর ফলক’, ‘ডিগবাজী’, উপলক্ষ’, ‘নেত্রপথ, জন্ম যদি তব বঙ্গে', এবং তিন মির্জা, ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আবু রুশদ খ্যাতি অর্জন করেছেন প্রথম যৌবন’, শাড়ী বাড়ী গাড়ী, রাজধানীতে ঝড়’, ‘মহেন্দ্র মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করে। আধুনিক সমাজের চিত্র তাঁর গল্পে প্রাণবন্ত রূপ লাভ করেছে।