রচনা: আইনের শাসন
-6697634eee9cf.png)
ভূমিকা:
‘রুল অব ল’ ইংরেজি এই তিনটি শব্দের অর্থ হচ্ছে আইনের শাসন। আধুনিক মূল্যবোধে আইনের শাসন আজ গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের এক অবিচ্ছেদ্য ভিত্তিরূপে পরিগণিত হচ্ছে। এটা প্রায় অবিসংবাদিত যে আইনের শাসন গণতন্ত্রের এক অনিবার্য উৎস এবং পূর্বশর্ত।
আইনের শাসন কী?:
আইনের শাসন ও সুশাসনের উপাদান এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় করণীয়:
আইনের শাসন নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে :
আইনের শাসনের প্রকারভেদ:
দেশভেদে আইনের শাসনের বিভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। ইংল্যান্ডে যেসব সাধারণ নীতি দ্বারা আইনের শাসন নিশ্চিত হয়েছে তার অধিকাংশই সেখানকার নাগরিকদের আদালতে উত্থাপিত বিভিন্ন মামলার বিচার বিভাগীয় রায়ের ফসল। ওইসব রায়ে নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকার নির্ধারিত হয়েছে এছাড়া ম্যাগনা কার্টা (১২১৫), দ্য পিটিশন অব রাইটস (১৬২৮) এবং বিল অব রাইটস (১৬৮৯) -এ ইংরেজদের স্বাভাবিক অধিকারসমূহ ঘোষিত হয়েছে, যা ওই দেশের আইনের শাসন নিশ্চিত করে। ইংরেজ জাতীয় ঐতিহ্য, রীতিনীতি, ব্যবহারবিধি এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকাশের দীর্ঘ ইতিহাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত অধিকার সম্পর্কে ইংরেজদের সচেতনতা গড়ে উঠেছে। সেগুলো পরবর্তী কালে সৃষ্ট অনেক রাষ্ট্রের লিখিত সংবিধানিক দলিলের মতোই পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়।
আইনের শাসন ও বাংলাদেশ:
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানে বিল অব রাইটস -এর অনেক বিষয় অনুরূপ ও সাধারণ বৈশিষ্ট্যসহ গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহ ছিল মর্যাদা, সুযোগ লাভ ও ধর্মপালনের অধিকারের সমতা; আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনতা ও বাঁচার অধিকার সুরক্ষা; অযৌক্তিক গ্রেফতার বা আটক, বিচার বা দণ্ড থেকে সুরক্ষা; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। সকল শ্রেণী এবং অভিন্ন আইনের অধীন যে আইন কার্যকর হবে সাধারণ আদালতের মাধ্যমে; জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে সে আইনের প্রয়োগ হবে সমান। এ মতবাদের আইনগত দিকটি আইনের শাসন দ্বারা পরিচালিত যে কোনো দেশেই একটি মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদেও এটা সুস্পষ্ট করা হয়েছে; সেখানে সরকারি চাকুরিতে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে, জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোনোরূপ বৈষম্যের শিকার হবে না। এটা সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রিয় প্রয়াসের ইঙ্গিতবহ। ৩২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সীমিত শাসন ও আইনের শাসনের ধারণাটি দৃঢ়তর হয়েছে, যেখানে একজন ব্যক্তির বাঁচার অধিকার ও স্বাধীনতা তথা মৌলিক অধিকারসমূহের মর্মবস্তু নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার অনুপস্থিতি ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের অঙ্গীকার রয়েছে এখানে। কিন্তু বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে এমন কোনো বিধান ছিল না যা মৌলিক অধিকারসমূহের মূল মর্ম সংকুচিত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, এ অবস্থা বেশিদিন বজায় থাকে না। দেড় বছরের মধ্যেই সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির বিধান সংযুক্ত হয়। অচিরেই নিরাপত্তা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং আরও কয়েকটি বিধিনিষেধমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়। সংবিধানে এসব পরিবর্তন ও সংযোজনের ফলে একটি মুক্ত সমাজের আদি আদর্শিক ধারণা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। এ ধরনের কয়েকটি কালো আইন এর মধ্যে -ছাপাখানা ও প্রকাশনা (প্রজ্ঞাপন নিবন্ধন) আইন ১৯৭৩, জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সংশোধনী) বিল ১৯৭৪ ও বিশেষ ক্ষমতা (সংশোধনী) বিল ১৯৭৪ এক্ষেত্রে সর্বাধিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানে কতিপয় সংশোধনী ঘটনা; কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ সকল নিরাপত্তা আইন অক্ষত রেখে দেওয়া হয় এবং সেগুলো আজও বলবৎ রয়েছে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলাকালে সকল প্রধান রাজনৈতিক দল এসব কালো আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায়। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে সবাই-ই এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে নীরবতা পালন করে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গণতান্ত্রিক সরকারের ভূমিকা:
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। যেমন-
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা:
বর্তমানে আমাদের সমাজজীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। আমাদের সমাজের সামনে আজ কোনো আদর্শ নেই। নেই অনুপ্রাণিত করার মতো কোনো মহৎ-প্রাণ মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের ফলে সমাজ জীবন অচল হয়ে পড়েছে। সমাজের সর্বক্ষেত্রে অপহরণ, শিশুপাচার, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, নারী নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস ইত্যাদির কাছে মুখ থুবড়ে পড়ছে আইনের সমুন্নত বাণী। এর জন্য অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা যেমন দায়ী তেমনি অনেকাংশে দায়ী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও। ফলে ভি আই পি অপরাধীরা আইনের ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে উঠে আইনের শাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে। ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করে নিয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে যারা, আইন তাদের কিছুই করতে পারছে না। বস্তুত আইনের শাসনকে ভূলুণ্ঠিত করায় সহায়তা করছে এক ধরনের রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী চক্র।
আশার কথা যে, বর্তমান সরকার সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদে বিশেষ অভিযান শুরু করেন। অবৈধ লেনদেন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও ক্ষমতা অপব্যবহারে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে সাবেক প্রধান মন্ত্রী (খালেদা জিয়া), মন্ত্রী, সাংসদ, আমলা থেকে শুরু করে হাতেনাতে গ্রেফতার হয়েছে অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী। রাজউক, চউক, পিডিবি, ডেসা, ক্রীড়া পরিষদ, স্বাস্থ্য বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, শিক্ষা ভবন, পিএসসি. পুলিশ বিভাগ, ব্যাংক, আয়কর বিভাগ, বন বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরে চলানো হচ্ছে শুদ্ধি অভিযান। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনকে একা কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়া হয়েছে। দেশব্যাপী যৌথবাহিনী, পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে জঙ্গি তৎপরতা, সর্বহারা তৎপরতা, বিচ্ছিন্ন সংঘাত-সংঘর্ষ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই ইত্যাদি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ধরনের পদক্ষেপ অব্যহত থাকলে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
উপসংহার:
দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, নীতিবোধ ও জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। ইতিহাসের নানা মোড় ফিরে এবং যোগ-বিয়োগ সেরে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা আমাদের ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা। আমরা আমাদের জাতীয় ভাষায় আমাদের সংবিধান রচনা করেছি। আমাদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের জন্য যদি আমরা ঈপ্সিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ যে অনিশ্চিত এ কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।