প্রবন্ধ কাকে বলে

Admin
November 27, 2024
277
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে এক নতুন ধরনের সাহিত্য শাখার উদ্ভব হল, যাকে আমরা বলতে পারি, প্রবন্ধ সাহিত্য। সাধারণত প্রবন্ধ গদ্যে রচিত হয়। প্রবন্ধের ভিত্তি মানুষের চিন্তা, মনন ও তত্ত্ব। তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে মননজ্যত কোনো বিষয়ের প্রতিষ্ঠা দান প্রবন্ধের লক্ষ্য।
প্রবন্ধ কি বা কাকে বলে :-
প্রবন্ধ কি? প্রবন্ধ শব্দটির প্রকৃতি প্রত্যয়গত অর্থ হ'ল 'প্ৰকৃষ্ট বন্ধন'। প্রবন্ধ কাকে বলে? 'প্রকৃষ্ট-বন্ধন' যুক্ত রচনাকেই প্রবন্ধ বলা হয়ে থাকে।
বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে সাধারণত জ্ঞান বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি চিন্তামূলক ও তত্ত্বমূলক বিষয় গদ্যবাহিত হয়ে প্রকাশ পায়। এই সমস্ত লেখার পেছনে থাকে যুক্তি। কোনো চিন্তাগ্রাহ্য বিষয়কে লেখক যখন যুক্তির সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তখন তা প্রবন্ধ হয়ে উঠে।
‘প্রবন্ধ' বা 'Essay' এক বিশেষ ধরনের গদ্যরচনা, ষোড়শ শতকে ফরাসি লেখক Michel de Montaigne তার 'Essais' (1580) গ্রন্থের শিরোনামে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন 'essai' বা 'attempt', অর্থাৎ প্রয়াস' এই মূলগত অর্থে।Montaigne ও বেকনেরও বহু পূর্বে প্রাচীনকালে গ্রিস ও রোমে প্রবন্ধধর্মী গদ্যরচনার চর্চা করেছিলেন। থিওফ্রাসটাস, প্লুতার্ক, সিসেরো এবং সেনেকা। প্রাচীন প্রয়োগে 'প্রবন্ধ' শব্দটির অর্থ ছিলো 'উপায়' বা 'ব্যবস্থা'। সংস্কৃত ভাষায় ‘প্রবন্ধ’ বলতে বোঝাতো 'প্রকৃষ্টরূপে বন্ধন' এবং সাহিত্যের সকল শাখাতেই প্রবন্ধের চলন ছিল।
প্রবন্ধ রচনার শ্রেনীবিভাগ :-
প্রবন্ধকে দুভাগে ভাগ করা হয় –
- তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ
- ব্যক্তিগত বা মন্ময় প্রবন্ধ
নীচে এই দুইপ্রকার প্রবন্ধ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
তন্ময় বা বস্তুগত প্রবন্ধ কাকে বলে :-
বস্তুগত বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ বলতে বোঝায় সেই ধরনের প্রবন্ধ যেখানে লেখক কোনও নির্দিষ্ট বিষয় বা বস্তু নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন।
বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে লেখক নিরাসক্তভাবে বিষয়ের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে যুক্তিশৃঙ্খলার মাধ্যমে গভীরভাবে বিষয় বিশেষণ করেন। চিন্তাশীল অনুসন্ধানী পাঠক এ জাতীয় প্রবন্ধের অনুরাগী।
বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ উদাহরণ :-
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'বাঙালি ভাষা' প্রবন্ধটি একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই প্রবন্ধে তিনি বাঙালির ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
অন্যদিকে, জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ঠাকুরের 'প্রবন্ধমধুরী' বা রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের 'নানা প্রবন্ধ' বইয়ের বিভিন্ন প্রবন্ধগুলিও উল্লেখযোগ্য। এগুলিতেও লেখকেরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে আলোচনা করেছেন।
সংক্ষেপে, বাংলা সাহিত্যে অনেক প্রবন্ধই এই ধরনের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণামূলক প্রবন্ধের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ কত প্রকার ও কি কি :-
এই বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধকে আবার মূলত ৭ টি ভাগে যায়। যথা, এগুলি হল-
১. বিবৃতি মূলক প্রবন্ধ : বিবৃতিমূলক বা গল্পাত্মক প্রবন্ধ বলতে বোঝায় সেরকম প্রবন্ধ যেখানে লেখক কোনও ঘটনা, অভিজ্ঞতা বা কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর ধারণা বা বক্তব্য তুলে ধরেন।
এখানে লেখক নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকেই বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। এটি প্রায়শই একটি ঘটনাচক্রের রূপ ধারণ করে থাকে।
উদাহরণ:
১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "ভূমি" প্রবন্ধটি
২) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "যাত্রাবৃত্তান্ত"
এসব প্রবন্ধে লেখকেরা নিজেদের কোনও অভিজ্ঞতা বা স্মৃতিকে বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
২. বর্ণনামূলক প্রবন্ধ : বর্ণনামূলক প্রবন্ধ বলতে বোঝায় সেই ধরনের প্রবন্ধ যেখানে লেখক কোনও বিষয়, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্থান বা ঘটনার সমগ্র বা শুধু কোনও দিকের বর্ণনা প্রদান করেন।
এখানে লেখক বিষয়বস্তুর বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে পাঠকের কাছে সেই বিষয়ের সম্পূর্ণ ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
৩. ব্যাখ্যামূলক প্রবন্ধ : ব্যাখ্যামূলক প্রবন্ধ বলতে বোঝায় সেই ধরনের প্রবন্ধ যেখানে লেখক কোনও কিছুর (যেমন - কোনও ঘটনা, মত, তত্ত্ব, আইন বা নীতি) সমগ্র অর্থ বা ব্যাখ্যা স্পষ্টভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
ব্যাখ্যামূলক প্রবন্ধে লেখক নিজের মতামত প্রকাশ করেন না, বরং বিষয়টির উপর প্রচলিত বিভিন্ন মতামত উল্লেখ করে বাস্তব, যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সবচেয়ে সঠিক ব্যাখ্যার দিকে পাঠককে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন।
৪. তথ্যমূলক প্রবন্ধ : তথ্যমূলক বা তথ্যভিত্তিক প্রবন্ধ বলতে বোঝায় সেরকম প্রবন্ধ যেখানে লেখক নির্দিষ্ট কোনও বিষয়ের উপর ভিত্তি করে প্রাসঙ্গিক তথ্য, পরিসংখ্যান এবং উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা প্রদান করেন।
এখানে লেখক নিজের মতামত প্রকাশ করেন না, বরং শুধুমাত্র বিষয়বস্তু সম্পর্কিত তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে পাঠকের অবহিতি বাড়ানোর চেষ্টা করেন।
৫. চিন্তামূলক প্রবন্ধ : চিন্তামূলক বা প্রমেয়মূলক প্রবন্ধ হল এমন প্রবন্ধ যেখানে লেখক কোনও নির্দিষ্ট বিষয়, ব্যাখ্যা বা প্রমেয নিয়ে নিজের যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা ও মতামত প্রকাশ করেন।
এখানে লেখক নিজের বিচার বুদ্ধি ও যুক্তির প্রয়োগ করে বিষয়টি বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেন। এছাড়াও তিনি নতুন কোনও ধারণা তুলে ধরতে পারেন।
৬. বিতর্কমূলক প্রবন্ধ : বিতর্কমূলক প্রবন্ধ হলো এমন একটি প্রবন্ধ যেখানে কোন বিতর্কিত বিষয়ের উপর দুই পক্ষের মতামত তুলে ধরা হয় এবং পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তি-তর্ক দিয়ে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়।
৭. নীতিকথা মূলক প্রবন্ধ : প্রচলিত নীতিকথা এই প্রবন্ধের স্থান লাভ করেছে । নীতিকথা মূলক প্রবন্ধের একটি উদাহরণ হতে পারে
শ্রম ছাড়া সফলতা আসে না :-
প্রাচীনকাল থেকেই 'শ্রম ছাড়া সফলতা আসে না' এই কথাটি আমাদের কানে পড়ে আসছে। এই নীতিকথার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে কোনো কাজে সফলতা পাওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম ছাড়া কোনো উপায় নেই।
যে কেউ যদি সফল হতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। কেউ যদি ভালো ফলাফল পেতে চায় তাহলে সে অবশ্যই ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে, পরীক্ষায় ভালো করতে হবে।