প্রাকৃতিক উপায়ে ঘুম আসার উপায়

Admin
October 17, 2024
293
ঘুম শরীরকে চাঙ্গা করে পরবর্তী দিনের কাজের জন্য আমাদের তৈরি করে। অনেকেই রয়েছেন যাঁরা ঘুম না হওয়ার সমস্যায় ভোগেন। এই সমস্যা অবসাদ ও ক্লান্তি তৈরি করে কর্মোদ্দম কমিয়ে দেয়। যাঁরা এ ধরনের সমস্যায় ভোগেন, তাঁরা হয়তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভরসা করেন ঘুমের ওষুধের ওপর। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বেশি ঘুমের ওষুধ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাহলে ওষুধকে এড়িয়ে কীভাবে ঘুম আসতে পারে? ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া বাতলে দিয়েছে ঘুম আসার কিছু প্রাকৃতিক উপায়ের কথা।
১। বিছানা থেকে উঠে যান
অনেকেই আছেন যাঁরা ঘুম না এলেও ঘুম আসার জন্য বিছানার এপাশ ওপাশ করতে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খেলা বন্ধ করুন এবং বিছানা থেকে উঠে যান। ২০, ৩০, ৪০ মিনিট- যতক্ষণ না ঘুম আসে বিছানায় আসবেন না। এই ৩০ থেকে ৬০ মিনিট এমন কিছু করুন যা আপনাকে ক্লান্ত করে দেবে। এই ক্লান্তি ঘুম আসতে সাহায্য করবে। তবে খুব বেশি আলোর মধ্যে কিছু করতে যাবেন না। তাহলে হিতে বিপরীত হয়ে ঘুম একেবারেই উধাও হয়ে যেতে পারে।
২। ক্যাফেইন এড়িয়ে যান
ক্যাফেইন-জাতীয় খাবার ঘুম তাড়িয়ে দেয়। তাই ঘুমের অন্তত পাঁচ ঘণ্টা আগে শেষ চা বা কফিটুকু পান করুন। এমনকি যাঁদের ঘুম ঠিকমতো না হওয়ার সমস্যা রয়েছে, তাঁদের দুপুরের খাবারের পর কফি না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
৩। গরম পানিতে গোসল
ঘুম না আসার সমস্যা হলে রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে উষ্ণ গরম পানি দিয়ে গোসল করুন। এই পদ্ধতি শরীরকে শিথিল করে ঘুম আসতে সাহায্য করবে।
৪। ধ্যান
একটি চমৎকার মেডিটেশন বা ধ্যান ঘুম আসতে বেশ কার্যকর। ২০০৯ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়, ধ্যান ইনসমনিয়া বা ঘুমের সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে। ধ্যান মন ও শরীকে শিথিল করে। এ ছাড়া ধ্যানের সময় গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ঘুম আসতে বেশ সাহায্য করে।
৫। শারীরিক পরিশ্রম
শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম ঘুম আসতে কার্যকর প্রাকৃতিক ওষুধ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যাঁরা শারীরিক পরিশ্রম করেন, তাঁদের ঘুম ভালো আসে। তাই ভালো ঘুম হতে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করুন।
৬। যোগব্যায়াম
সারা বিশ্বেই যোগব্যায়াম করা ভালো ঘুম হওয়ার জন্য একটি প্রাকৃতিক উপায়ের নাম। যোগব্যায়াম শরীরকে শিথিল রাখতে সাহায্য করে এবং ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে।
৭। অ্যারোমা থেরাপি
অ্যারোমা থেরাপির মধ্যে যে প্রয়োজনীয় ভেষজ তেল, বাথ স্ক্রার, চোখের মাস্ক ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় সেগুলো ভালো ঘুম হতে উপকার করে। ২০০৫ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়, ভেষজ তেলের ঘ্রাণ গভীর ঘুমের জন্য বেশ উপকারী। তাই যাঁরা ঘুম না হওয়ার সমস্যায় ভুগছেন, তাঁরা পার্লারে গিয়ে অ্যারোমা থেরাপি নিয়ে দেখতে পারেন।
৮। শোবার ঘর
ভালো ঘুমের জন্য শোবার ঘরও হওয়া চাই উপযুক্ত। আপনি হয়তো এমন ঘরে ঘুমালেন, যার আশপাশে অনেক শব্দ হয় বা প্রচুর আলো এসে পড়ে। এগুলো ঘুমকে ব্যাহত করে। তাই শোবার ঘরের কিছু পরিবর্তন জরুরি। একটু মন দিয়ে ভাবুন কী পরিবর্তন করলে আপনার শোবার ঘরটি ঘুমের উপযুক্ত হবে? সেটা হতে পারে ম্যাট্রেসের পরিবর্তন বা জানালায় ভারী পর্দা লাগানো। এ ছাড়া ভালো ঘুমের জন্য টিভি, কম্পিউটার এসব জিনিসগুলোও শোবার ঘর থেকে দূরে রাখুন। কেননা এগুলোও ভালো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়।
৯। ভেষজ চা
ঘুমের আগে চা-কফি একদম খাবেন না, তবে ক্যাফেইন ছাড়া ভেষজ চা খেতে পারেন। যেমন : ভ্যালেরিয়ান অথবা ক্যামোমিল চা ইত্যা্দি ঘুমের আগে খেতে পারেন। এগুলো ঘুম ভালো করতে সাহায্য করবে।
১০। প্রোগ্রেসিভ মাসেল রিলাক্সেন ব্যায়াম
১৯১৫ সালে আবিষ্কার হওয়া ব্যায়ামের এই পদ্ধতি এখনো পুরোনো হয়নি। প্রোগ্রেসিভ মাসেল রিলাক্সেন ব্যায়াম এমন একধরনের ব্যায়াম যা পেশিকে শিথিল করে। এটি অবসন্নতা দূর করে ঘুমের পরিমাণ বাড়ায়। তাই ফিটনেস প্রশিক্ষকের পরামর্শ নিয়ে এ ধরনের ব্যায়ামও শিখতে পারেন।
দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার ৫ কৌশল
অপর্যাপ্ত ঘুম ব্যক্তির স্মৃতি, চেতনা, আবেগ, সংবেদনশীলতা ও মস্তিষ্ক ও দেহের বহু প্রক্রিয়াতে ব্যাঘাত ঘটায়। যদি কারো ঘুমের সমস্যা হয়, তবে এই ৫টি কৌশলের যেকোনো একটি ব্যবহার করে দেখতে পারেন।
৪-৭-৮ পদ্ধতি
ডক্টর অ্যান্ড্রু ওয়েইলসের '৫-৭-৮' পদ্ধতি পালনের ফলে মানবমনে আরাম ও প্রশান্তি আসে। এটি যোগব্যায়াম থেকে অনুপ্রাণিত এক ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি, যা কি না ব্যক্তির স্নায়ুতন্ত্রকে আরামদায়ক অবস্থায় নিয়ে যায়। যখনই কোনো ধরনের মানসিক চাপ অনুভূত হবে তখন এই পদ্ধতিটি কাজে লাগানো যায়। এর জন্য প্রথমেই জিভকে সবচেয়ে সামনের দিকে ওপরের দাঁতের পেছনে নিয়ে যেতে হবে। এরপর 'হুশ' শব্দ করে বড় একটি শ্বাস ছাড়তে হবে।
ঠোঁট দুটো বন্ধ করে ৪ পর্যন্ত গুনে আবার শ্বাস গ্রহণ করতে হবে। তারপর শ্বাস আটকে রেখে মনে মনে ৭ পর্যন্ত গুনতে হবে এবং এ পদ্ধতির চূড়ান্ত পর্যায়ে আবারও একটি 'হুশ' শব্দে বড় একটি শ্বাস ছাড়তে হবে। এ সময় মনে মনে ৮ পর্যন্ত গুনে যেতে হবে। এই পদ্ধতিটি মোট ৩ বার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। ভালোভাবে মেনে চলতে পারলে একইসঙ্গে মানসিক বিশ্রাম ও দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে পদ্ধতি কার্যকর হবে।
মিলিটারি বা সামরিক পদ্ধতি
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে প্রি-ফ্লাইট স্কুলের একটি প্রোগ্রামের জন্য ২ মিনিট বা তারও কম সময়ে পাইলটদের ঘুমিয়ে পড়ার জন্য এই সামরিক পদ্ধতিটি শ্যারন অ্যাকারম্যানের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়। এমনকি ঘুমের আগে কফি পান করলে বা বন্দুকের গুলির আওয়াজ শোনার পরও এ পদ্ধতি কার্যকর হয়। এজন্য মুখের পেশিগুলোকে শিথিল করে নিতে হবে। কাঁধটা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে হাত দুটোকে ২ পাশে বিশ্রামের অবস্থায় রাখতে হবে। এরপর বুকের অংশটুকুও শিথিল করে রেখে শ্বাস ছাড়তে হবে। এবার আপনার হাতের উপরের অংশ, উরু ও পাগুলোও শিথিল অবস্থায় ছেড়ে দিন।
১০ সেকেন্ডের জন্য প্রশান্তিদায়ক কোনো দৃশ্য ভাবুন। যদি এতেও কাজ না হয়, তবে ১০ সেকেন্ডের জন্য 'কোনো চিন্তা নেই' বা এমন ধরনের কোনো নিজস্ব 'মন্ত্র' আওড়ান। সামরিক ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি যেহেতু ঘুমের জন্য বেশ ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে, শোবার ঘরে আরও সহজ হবার কথা।
স্কেজিউল বা রুটিন পদ্ধতি
মানুষের শরীরে সার্কাডিয়ান রিদম নামে একটি নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা রয়েছে। এই দেহঘড়ি দিনে শরীরকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে এবং রাতের বেলা ঘুম ঘুম ভাব আনে। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে উঠা এবং বিছানায় যাওয়ার ফলে দেহঘড়িতে ভালোভাবে 'দম দেওয়া' তথা একটি রুটিন তৈরি করা সম্ভব। একবার শরীর এই রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে প্রতিদিন একই সময় ঘুমিয়ে পড়া সহজ হয়ে যায়।
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এটি বেশ অনুকূল একটি পদ্ধতি, বিশেষ করে তাদের মানসিক স্থিরতা ও সুস্থতার জন্য এই রুটিনটি সহায়ক ভূমিকা রেখে থাকে। সেইসঙ্গে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রতি রাতে ৩০-৪৫ মিনিট নিজেকে সব ঝামেলা ও দুশ্চিন্তা থেকে মানসিকভাবে প্রশান্ত করার চেষ্টা করুন। এতে করে শরীর ও মন উভয়েই বিশ্রাম পায় এবং ঘুমিয়ে পড়তেও সুবিধা হয়।
পিএমআর পদ্ধতি
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের সঙ্গে দেহের পেশিগুলোর ছন্দময় উঠানামার পদ্ধতিকে বলা হয় প্রগ্রেসিভ মাসল রিলাক্সেশন বা পিএমআর। এ প্রক্রিয়ায় দেহের প্রধান পেশিগুলোকে কিছুটা সক্রিয় করে তারপর শিথিল করে দিতে হয়। প্রথমেই চোখ বন্ধ করে নিয়ে ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিতে হবে। এরপর ১০ সেকেন্ড মুখের পেশিগুলোর ওপর চাপ দিতে হবে। এরপর আবার পেশিগুলো শিথিল করে দিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে শান্ত হতে হবে।
এরপরের ১০ সেকেন্ড কাঁধের পেশিগুলোর ক্ষেত্রেও একই কাজ করতে হবে। কয়েকটি গভীর শ্বাস নিতে হবে এবং ছাড়তে হবে। শরীরের অন্য পেশিগুলোর সঙ্গেও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণরূপেই 'আপাদমস্তক', শুরুটা কাঁধের পেশি থেকে হবে এবং শেষটা হবে পা ও পায়ের আঙুলের পেশির ব্যায়াম দিয়ে। কোনো অংশে ব্যথা হলে সেটি বাদ দিতে হবে এবং এভাবেই পিএমআর পদ্ধতি মেনে দ্রুত ঘুম চলে আসবে।
গাইডেড ইমেজারি পদ্ধতি
ঘুমানোর আগে এদিক-সেদিকের নানা অপ্রীতিকর ঘটনার কথা চিন্তা না করে নিজেকে কল্পনায় নিয়ে যেতে হবে মনোরম কোনো স্থানে। যেখানে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। একটি গবেষণার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দেখা গেছে, মানসিকভাবে মনোযোগ সরিয়ে নেয়ার জন্য 'গাইডেড ইমেজারি', তথা কল্পিত দৃশ্যাবলীর পদ্ধতিটি বেশ কার্যকর। এতে করে তারা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন।
বিছানায় যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে রাতে ঘুম ভালো আসে এবং মন থেকে আজেবাজে চিন্তা সরে গিয়ে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। রাতে ঘুমানোর সময় যেসব চিন্তা চোখের ঘুম কেড়ে নেয়, তা থেকে মন সরিয়ে নেওয়াই বিচক্ষণের কাজ। এতে করে বিশ্রামের সময়টা প্রশান্ত আর আনন্দময় দৃশ্য ভেবে নিয়ে ভালোভাবে বিশ্রাম করা যাবে।