আল্লাহ তা‘আলা কিছু মাস, দিন ও রাতকে ফযীলতপূর্ণ করেছেন। যেমন রামাযান মাসকে অন্য সকল মাসের উপর মহিমান্বিত করেছেন। আরাফাতের দিন ও ঈদের দিনকে অন্য দিনের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। ক্বদরের রাতকে অন্যান্য রাতের চেয়ে মর্যাদামন্ডিত করেছেন। আসন্ন যিলহজ্জ মাস অনুরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মাস। যে মাসে হজ্জ ও কুরবানী করা হয়ে থাকে। এই মাসের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বিস্তর আলোচনা এসেছে। আলোচ্য প্রবন্ধে যিলহজ্জ মাসের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করা হ’ল।-
কোরআন ও হাদিসের আলোকে জিলহজ মাসের প্রথম দশকের বিশেষ ১০ আমল
তাওবা করা
তাওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা বা ফিরে যাওয়া। যেসব কথা ও কাজ আল্লাহ অপছন্দ করেন তা বর্জন করে যেসব কথা ও কাজ তিনি পছন্দ করেন তার দিকে ফিরে যাওয়া। অতীতে এ ধরনের কাজে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে ঐকান্তিকভাবে অনুতাপ হওয়া। কাজগুলো পরিত্যাগ করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা। আল্লাহর পছন্দের কাজগুলো করা ও অপছন্দের কাজগুলো ত্যাগ করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া। কেবল কৃত পাপের জন্য তাওবা নয় বরং অতীতের সব পাপের জন্যই তাওবা করা। তাওবার আবশ্যকতা বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর,বিশুদ্ধ তাওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে প্রবাহিত রয়েছে নদী। সে দিন আল্লাহ লজ্জিত করবেন না নবীকে এবং তার মুমিন সঙ্গীদেরকে, তাদের জ্যোতি তাদের সম্মুখে ও দক্ষিণ পাশে ধাবিত হবে। তারা বলবে হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর, নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৮)
অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির করা
মহান আল্লাহ বলেন, যেন তারা তাদের জন্য স্থাপিত কল্যাণসমূহ প্রত্যক্ষ করে এবং নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। (সুরা হজ, আয়াত: ২৮)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, উক্ত আয়াতে নির্দিষ্ট দিন বলে জিলহজের প্রথম দশককে বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ৫/৪১৫)
নেক আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মহান আল্লাহর কাছে অন্যান্য সময়ের আমলের চেয়ে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের আমল অধিক প্রিয়। (বুখারি: ৯৬৯)
সামর্থ্যবান হলে হজ করা
হজ ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের একটি স্তম্ভ। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের ওপর হজ আদায় করা ফরজ। আবার কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া অন্য কিছু নয় মর্মে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুসংবাদ রয়েছে। (তিরমিজি: ৮১০)
সামর্থ্য থাকলে কোরবানি করা
মহান আল্লাহ বলেন, তুমি নিজ প্রতিপালকের জন্য সালাত আদায় কর ও কোরবানি কর। (সুরা কাউসার, আয়াত: ২)
চুল-নখ না কাটা
যে ব্যক্তি কোরবানি দেবে তার জন্য জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে কোরবানি করার আগ পর্যন্ত শরীরের পশম, চুল ও নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব। হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, তিনি বলেন, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,যখন (জিলহজ মাসের) প্রথম দশক শুরু হয় এবং তোমাদের কেউ কোরবানি করার ইচ্ছা রাখে, সে যেন তার চুল ও শরীরের কোনো অংশ স্পর্শ না করে (না কাটে)। (মুসলিম: ১৯৭৭)
তাকবির, তাহমিদ ও তাহলিল পাঠ করা
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ- পড়া। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
আল্লাহর কাছে জিলহজের দশদিনের আমলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও প্রিয় আমল নেই। অতএব, এ দিনগুলোতে তোমরা অধিক পরিমাণে তাকবির, তাহমিদ ও তাহলিল পাঠ করো। (আল-মুজামুল কাবির: ১১১১৬)
জিলহজ মাসের পাঁচ দিন তাকবিরে তাশরিক আদায় করা
তাকবিরে তাশরিক হলো-
اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ وَ اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر وَ للهِ الْحَمْد উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ। অর্থ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; সব প্রশংসা মহান আল্লাহ জন্য।
আর তা শুরু হয় ৯ জিলহজ ফজর নামাজের পর থেকে। আর শেষ হবে ১৩ জিলহজ আসার নামাজে। যা এ পাঁচ দিন ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর পড়া ওয়াজিব। চাই নামাজ একাকী আদায় করা হোক বা জামাতে।
তাকবিরে তাশরিক পুরুষরা উচ্চ স্বরে আর নারীরা সশব্দে পড়বে। অর্থাৎ নারীদের তাকবিরের শব্দ যেন (গাইরে মাহরাম) অন্য লোকে না শোনে।
প্রথম নয়দিন রাজা রাখা
কোনো কোনো বর্ণনায় জিলহজের প্রথম নয় দিনই সিয়াম পালনের নির্দেশনা পাওয়া যায়। তাছাড়া এই দিনগুলোর নেক কাজ আল্লাহর প্রিয় হওয়ায় এর সব দিনেই নফল সিয়াম রাখা যায়। অনেক ইমামগণও যিলহজের প্রথম নয় দিন সিয়াম পালন করাকে মুস্তাহাব বলেছেন।
আরাফার দিন বিশেষভাবে রোজা রাখা
হযরত হাফসা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, তিনি বলেন-
أَرْبَعٌ لَمْ يَكُنْ يَدَعُهُنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: صِيَامَ عَاشُورَاءَ، وَالْعَشْرَ، وَثَلَاثَةَ أَيّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ الْغَدَاةِ অর্থ: চারটি আমল নবীজি কখনও ছাড়তেন না। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোজা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ। (নাসায়ি: ২৪১৫)
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
আরাফার দিন রোজা রাখলে আশা করা যায় মহান আল্লাহ তার পেছনের এবং সামনের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (মুসলিম: ১১৬২)