গিফেন দ্রব্য কি

Admin
March 03, 2025
97
গিফেন দ্রব্য কি, আপনি কি জানেন যে কিছু দ্রব্যের দাম বাড়লে তাদের চাহিদা বাড়ে না, বরং বেড়ে যায়? আশ্চর্য হলেও এটি বাস্তব এবং অর্থনীতির একটি বিশেষ তত্ত্বের মধ্যে পড়ে — যাকে বলা হয় “গিফেন দ্রব্য”।
এই দ্রব্য এমন একটি অর্থনৈতিক ধারণা যা অর্থনীতির জগতকে একটু চমকে দেয়। সাধারণভাবে, যখন কোনো দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়, তখন তার চাহিদা কমে যায়। কিন্তু গিফেন দ্রব্যের ক্ষেত্রে ঠিক এর উল্টো ঘটে। এর উদাহরণ আমাদের বাস্তব জীবনে অনেকটা দুর্লভ, তবে এটি অর্থনৈতিক তত্ত্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গিফেন দ্রব্য কি, এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব এর উদাহরণ, বৈশিষ্ট্য এবং এর ব্যবহারিক প্রভাব নিয়ে।
গিফেন দ্রব্য কি
এমন একটি বিশেষ ধরনের দ্রব্য হলো গিফেন দ্রব্য যা অর্থনীতির সাধারণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে কাজ করে। এটি এমন একটি দ্রব্য, যার দাম বাড়ানোর পরেও তার চাহিদা বাড়তে থাকে, যা অর্থনীতির সাধারণ নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে। সাধারণভাবে, দ্রব্যের দাম বাড়লে তার চাহিদা কমে, এটি “ডিমান্ড কার্ভ” বা চাহিদার রেখার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু গিফেন দ্রব্যের ক্ষেত্রে চাহিদা বৃদ্ধি পায় যখন দাম বাড়ে।
অর্থাৎ, গিফেন দ্রব্য এমন এক ধরনের দ্রব্য যা ইনফেরিয়র গুডস (Inferior Goods) হিসেবে কাজ করে। এটি এমন একটি দ্রব্য যা অধিকাংশ মানুষের কাছে “নিম্নমানের” মনে হলেও, চাহিদা বাড়ে যখন এই দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। এর পেছনে রয়েছে একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব যা “গিফেন প্যারাডক্স” (Giffen Paradox) হিসেবে পরিচিত।
গিফেন দ্রব্যের উদাহরণ
গিফেন দ্রব্যের কিছু বাস্তব উদাহরণ জানা যাক। যদিও গিফেন দ্রব্যের অস্তিত্ব বাস্তব জীবনে অনেকটাই বিরল, তারপরও কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এই ধরনের দ্রব্য পাওয়া যেতে পারে। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল:
ভাত (Rice): গিফেন দ্রব্যের একটি জনপ্রিয় উদাহরণ। দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অঞ্চলে, যখন খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পায়, সেখানে ভাতের চাহিদা বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ভাতের দাম বেড়ে যায়, গরীব পরিবারগুলি তাদের বাজেটে সামঞ্জস্য রাখতে ভাতের পরিমাণ আরো বেশি কিনে নেয়, অন্য কোনো পণ্যের বদলে। এই ক্ষেত্রে, ভাতের দাম বাড়ানোর পরেও তার চাহিদা বাড়তে থাকে, কারণ এটি তাদের প্রধান খাদ্য এবং অন্যান্য খাদ্যের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়।
রুটি (Bread): অনেক উন্নয়নশীল দেশে, যখন অন্যান্য খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়, তখন রুটির চাহিদা বৃদ্ধি পেতে পারে। এক্ষেত্রে, রুটি একটি প্রধান খাদ্য দ্রব্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং মানুষ যদি অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়, তারা রুটি কিনে নেয় এবং একে তাদের খাদ্য তালিকার অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে রেখে দেয়।
পেঁয়াজ (Onions): কিছু দেশে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণে, মানুষের চাহিদা বাড়তে পারে, কারণ এটি একটি মূল রান্নার উপকরণ এবং চাহিদা যত বাড়ে, পেঁয়াজের দামও উত্থিত হয়।
তবে এই উদাহরণগুলি প্রতিটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সমাজের সাপেক্ষে পরিবর্তিত হতে পারে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে, গিফেন দ্রব্যের উদাহরণ হিসাবে ভাত এবং রুটি সাধারণত ব্যবহৃত হয়, তবে এই ধারণাটি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবে প্রমাণিত নয়।
গিফেন দ্রব্যের বৈশিষ্ট্য
গিফেন দ্রব্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাকে সাধারণ দ্রব্য থেকে আলাদা করে। গিফেন দ্রব্যের চাহিদা সাধারণ অর্থনৈতিক তত্ত্বের বিপরীতে কাজ করে। এখানে কিছু মূল বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:
দাম বৃদ্ধির পর চাহিদার বৃদ্ধি: গিফেন দ্রব্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এর দাম বাড়ানোর পরেও এর চাহিদা বাড়ে। সাধারণভাবে, দ্রব্যের দাম বাড়লে তার চাহিদা কমে, তবে গিফেন দ্রব্যের ক্ষেত্রে এটি উল্টো ঘটে।
নিম্নমানের দ্রব্য: গিফেন দ্রব্য সাধারনত নিম্নমানের দ্রব্য হিসেবে চিহ্নিত হয়। অর্থাৎ, এটি এমন একটি দ্রব্য যা সাধারণত কম আয়ের মানুষ ব্যবহার করে এবং দাম বেড়ে গেলে তাদের কাছে অন্য বিকল্পের তুলনায় এটি সস্তা এবং প্রয়োজনীয় মনে হয়।
Substitution Effect – এর বিপরীতে: সাধারণত, যখন কোনো দ্রব্যের দাম বাড়ে, তখন মানুষ অন্য পণ্যগুলির দিকে সরে যায় (substitution effect)। তবে গিফেন দ্রব্যের ক্ষেত্রে এটি ঘটে না, কারণ দাম বাড়লে সাধারণত ঐ দ্রব্যের প্রতি মানুষের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়, যেমন ভাত বা রুটি।
Income Effect – এর বিপরীতে: সাধারণত যখন কোনো দ্রব্যের দাম বাড়ে, তখন এর Income Effect দ্বারা মানুষের কেনার ক্ষমতা কমে যায়, ফলে তারা সেই দ্রব্য কিনতে আগ্রহী হয় না। কিন্তু গিফেন দ্রব্যের ক্ষেত্রে এই Income Effect প্রভাবিত হয় না, বরং চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
গিফেন দ্রব্যের চাহিদা রেখা
গিফেন দ্রব্য সাধারণত নিকৃষ্ট দ্রব্যের পর্যায়ভুক্ত। ১৮৪০ এর দশকে আলুর ক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষের সময় স্যার রবার্ট গিফেন আইরিশ কৃষকদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে তার বক্তব্য প্রদান করেন। অত্যন্ত নিম্ন আয়সম্পন্ন পরিবারের মূল খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা বিবেচনার ক্ষেত্রে গিফেন পদটি ব্যবহৃত হয়। তাঁর মতে, গিফেন দ্রব্যের দাম বাড়লে চাহিদা বাড়ে এবং দাম কমলে চাহিদা কমে। এর পক্ষে তার যুক্তি হল মূল খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তে থাকলে নিম্ন বেতনভুক্তরা যখন দেখে যে অন্য দ্রব্য ক্রয়ের সামর্থ্য নেই তখন তারা মূল খাদ্যদ্রব্যটি আরও বেশি পরিমাণে ক্রয় করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেনে যারা কম বেতনভুক্ত শ্রমিক, তাদের চাহিদার প্রকৃতি বিশ্লেষণে লক্ষ্য করা গিয়েছিল যে, পাউরুটির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা পাউরুটির ক্রয় না কমিয়ে বরং বাড়িয়েছিল। কারণ নিম্ন বেতনভুক্ত ব্যক্তিরা বেঁচে থাকার জন্যে পাউরুটির উপর নির্ভরশীল ছিল, দাম বাড়াতে তাদের সন্দেহ ছিল ভবিষ্যতে দাম আরও বাড়লে তারা অর্থের অভাবে পাউরুটি ক্রয় করতে পারবে না। এবং না খেয়ে মরতে হবে এ আশঙ্কায় তারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দামে বেশি করে পাউরুটি ক্রয় করতে থাকে। সুতরাং, যেসব মৌলিক খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়লে চাহিদা বাড়ে সেসব দ্রব্যকে গিফেন দ্রব্য বলে। গিফেন দ্রব্যের ক্ষেত্রে দাম বাড়লে চাহিদা বাড়ে এবং দাম কমলে চাহিদা কমে। ফলে গিফেন দ্রব্যের চাহিদা রেখা বাম দিক থেকে ডান দিকে ঊর্ধ্বগামী হয়।
গিফেন দ্রব্য অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, যা সাধারণভাবে জানা অর্থনৈতিক নিয়মের বিপরীতে কাজ করে। এটি এমন একটি দ্রব্য, যার দাম বৃদ্ধির পরও তার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। গিফেন দ্রব্যের উদাহরণ, বৈশিষ্ট্য, তত্ত্ব এবং বাস্তব প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে এটি বুঝতে পারা সম্ভব যে, এই ধারণাটি কিছু পরিস্থিতিতে কার্যকরী হলেও সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়।
এটা ঠিক যে, গিফেন দ্রব্য এর বর্তমান বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের প্রভাব নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে, তবে এর তত্ত্বের মাধ্যে অর্থনীতি অধ্যয়ন করতে আগ্রহী ব্যক্তিরা অনেক কিছু শিখতে পারে। এই পণ্যগুলির বৈশিষ্ট্য এবং প্রভাব সাধারণ অর্থনীতির ধরণকে চ্যালেঞ্জ করে এবং একে আরও গভীরভাবে বুঝতে আমাদের সাহায্য করে।