রচনা: শরৎকাল

রচনা: শরৎকাল
Admin June 27, 2024 101

ভূমিকা:

‘শরৎ,তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে-
বনের পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।
---রবীন্দ্রনাথ
ঋতু-রঙ্গমঞ্চে যখন অগ্নিক্ষরা গ্রীষ্মের আতঙ্ক-পাণ্ডুর বিবর্ণতা মুছে গেছে, যখন বর্ষার বিষণ্ণ-বিধুর নিঃসঙ্গতা আর নেই, তখনই নিঃশব্দ চরণ ফেলে শরতের আবির্ভাব। মুখে তার প্রসন্ন হাসি। অঙ্গে তার স্বর্ণবরণ মোহন কান্তি। তার স্নিদ্ধ রূপ-মাধুর্য সহজেই আমাদের মনকে নাড়া নেয়। শরৎ যে পূর্ণতার ঋতু! শরৎ আসে হালকা চপলা ছন্দে। এসেই মেঘ আর রৌদ্রের লুকোচুরি খেলায় মাতে। শরৎ শুভ্রতার প্রতীক। গাছের পাতায় ঝকঝকে রোদের ঝিলিক, ভরা নদীর পূর্ণতা, নদীতীরে ফুটে থাকা অজস্র কাশফুল, শিউলি আর সারা আকাশ জুড়ে তুলোর মতো শুভ্র মেঘ-এসবই জানিয়ে দেয় শরৎ এসে গেছে। তাই রৌদ্রবরণ, শুভ্রতার প্রতীক শরৎই আমার প্রিয় ঋতু।

পর্যায়কাল ও বৈশিষ্ট্য :

বর্ষার অবসানে তৃতীয় ঋতু শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে আবির্ভূত হয়। ভাদ্র ও আশ্বিন (আগস্ট মাসের মধ্যভাগ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত) মিলে শরৎকাল। ভাদ্র (সেপ্টেম্বর) মাসে তাপমাত্র আবার বৃদ্ধি পায়, আর্দ্রতাও সর্বোচ্চে পৌঁছে। শরৎকালে বনে-উপবনে শিউলি, গোলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী প্রভৃতি ফুল ফোটে। বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা আর নদীর ধারে কাশফুল। এ সময়ে তাল গাছে তাল পাকে। হিন্দুদের দুর্গাপূজাও এ সময় অনুষ্ঠিত হয়।

শরতের অনুপম রূপরাশি:

ঋতুরঙ্গশালায় শরৎ আর বসন্ত হল শূদ্র।
‘একজন শীতের আর একজন গ্রীষ্মের তলপি বহন করিয়ে আনে। মানুষের সঙ্গে এখান প্রকৃতির তফাত। প্রকৃতির ব্যবস্থায় যেখানে সেবা সেইখানেই সৌন্দর্য, যেখানে নম্রতা সেইখানেই গৌরব। তাহার সভায় শূদ্র যে সে ক্ষুদ্র নহে, ভার যে বহন করে সমস্ত আবরণ তাহারই। তাই তো শরতের নীল পাগড়ির উপরে সোনার কলকা, বসন্তের সুগন্ধ পীত উত্তরীয়খানি ফুলকাটা। ইহারা যে পাদুকা পরিয়া ধরণী-পথে বিচরণ করে তাহা রঙ-বেরঙের সূত্রশিল্পে বুটিদার; ইহাদের অঙ্গদে কুণ্ডলে কুণ্ডলে অঙ্গুরীয়ে জহরতের সীমা নাই।
হালকা কুয়াশা আর বিন্দু বিন্দু মজে ওঠা শিশির, শারদপ্রভাতের প্রথম সলজ্জ উপহার। এর ওপর যখন সূর্যের আলো পড়ে তখন মনে হয় চারদিকে ছড়িয়ে আছে অজস্র মুক্তোদানা। যথার্থই শরতের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের তুলনা নেই। আকাশে এখন গাঢ় নীলিমার অবারিত বিস্তার। ক্ষান্ত-বর্ষণ সুনীল আকাশের পটভূমিকায় জলহারা লঘুভার মেঘপুঞ্জ। ধীর মন্থর ছন্দে তার কেবলই সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ যাত্রা। দিকে দিকে তার প্রসন্ন হাসির নম্র আভা। নদী-সরসীর বুকে কুমুদ-কলমের নয়ন-মুগ্ধকর সমারোহ-শোভা। দিগন্ত-বিস্তার সবুজ ধানের ক্ষেত। তার শ্যামশস্য হিল্লোলে আনন্দ-গুঞ্জরণ। গাছে গাছে পত্রপল্লবে সবুজের ছড়াছড়ি। প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে শেফালি-সৌরভ। আঙিনায় আঙিনায় গুচ্ছ গুচ্ছ দোপাটির বর্ণসজ্জা। নদীকূলে কাশের বনে শুভ্র তরঙ্গ-কম্পন। প্রভাতে তৃণপল্লবে নবশিশিরের ভীরু স্পর্শ। তাতে অরুণ-আলোর রক্ত-আভার লজ্জানম্র ভুবন-ভোলানো রূপ-কান্তি। গাছে গাছে, ডালে ডালে, দোয়েল পাপিয়ার প্রাণমাতানো সুরমূর্ছনা। নৈশ নীলাকাশে রজতশুভ্র জোছনার উদাস-করা হাতছানি। শারদ-লক্ষ্মীর এই অপরূপ রূপলাবণ্য মর্ত্যভূমিকে করেছে এক সৌন্দর্যের অমরাবতী।

শরতের রাত:

স্নিগ্ধতা আর কোমলতার এক অপূর্ব রূপ নিয়ে আসে শরতের রাতে। শরৎ-রাত্রির চাঁদ সারা রাত ধরে মাটির শ্যামলিমায় ঢেলে দেয় জোছনাধারা। মাঝে মাঝে বয়ে যায় স্নিগ্ন বাতাস। দূর থেকে ভেসে আসে শিউলির সুবাস। মন কিছুতেই ঘরে আটকে থাকতে চায় না। কেবলই ছুটে যেতে চায় বাইরে। ঝকঝকে জোছনায় পাখিদের ভ্রম হয়। ভোর হয়ে গেছে ভেবে ডেকে ওঠে কাক। ভোর হতে না হতেই শিশিরসিক্ত শিউলি ঝরে পড়ে সবুজ ঘাসে। কমলা বোঁটায় তখনও টলমল করে জলের কণা। কবি-

হৃদয় চঞ্চল হয়। লেখে কবিতা কিংবা গান:
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা
নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজায়ে এনেছি বরণডালা।’
শরতে নীল সরোবরে পদ্মের সাথে হৃদয় মেলে ফুটে ওঠে বাংলাদেশের প্রাণ। শরতে কেবলি বর্ণের স্নিগ্ধতা আর উদারতা। সবুজ, নীল আর সাদার এমন অপূর্ব সমন্বয় আর কোনো ঋতুতে দেখা যায় না। জননী বাংলাদেশ আপনার হৃদয় উজাড় করে মেলে ধরে এই শরতে।

শরতের উৎসব:

এমনি করেই ধীরে ধীরে উৎসবের সাজে সেজে ওঠে শস্যবিচিত্রা ধরিত্রী। আকাশে-বাতাসে বাসে মধুর আগমনী গান। মানুষের মনে লাগে উৎসবের রঙ। শরতের ভুবনবিজয়ী রূপের প্রেক্ষাপটেই রচিত হয় উৎসব-বেদী। বাঙালির হৃদয়মন আসন্ন উৎসবের আনন্দ-জোয়ারে প্লাবিত হয়। বাঙালির মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ শারদ-উৎসব দুর্গাপূজার আয়োজনে মুখরিত হয় বাংলার গ্রাম-নগর। দিকে দিকে তারই আনন্দ-স্রোত, কলোচ্ছ্বাস।
ছুটির ঋতু শরৎ:
শরতের অনুপম রূপ-বৈভবের মাঝখানেও বাঙালির মনে বেজে ওঠে ছুটির বাঁশি। আকাশে-বাতাসে তার উদার মুক্তির আহ্বান। জোছনা-পুলকিত রাত্রির মোহিনী রূপ বাঙালিকে উতলা করে। ঘরের বন্ধন ছিন্ন করে সে ওই অফুরান সৌন্দর্যের জোয়ারে ভেসে যেতে চায়। তার শিউলি-বিতানে, শিশির-সিক্ত তৃণপল্লবে, আকাশে সীমাহীন নীলিমায়, দোয়েল-শ্যামার কলকণ্ঠ, ভ্রমরের-গুঞ্জনে তার কেবলই উদাস হাতছানি ছুটির সাদর আমন্ত্রণ। একে উপেক্ষা করার সাধ্য কার! গৃহবন্দী জীবনের ক্লান্তি ভুলতে সে দূর-দূরান্তরে বেরিয়ে পড়ে। শরৎ তাই ছুটির ঋতু। অবকাশের ঋতু। বাঙালির মনকে সে করেছে সৌন্দর্যের তীর্থাভিমুখী। ‘শরতের রৌদ্রের দিকে তাকাইয়া মনটা কেবল চলি চলি করে- বর্ষার মতো সে অভিসারে চলা নয়, সে অভিমানের চলা।’

শরতের অর্থনৈতিক অবদান :

শরৎ ফসলের ঋতু নয়। আগামী ফসলের সম্ভাবনার বাণীই সে বহন করে আনে। পাকা ধানের ডগায় সোনালি রোদ গলে গলে পড়ে। চকচক করে কৃষকের চোখ আনন্দে। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেত দেখে কৃষক আশায় বুক বাঁধে। আর কিছুদিন পরেই ঘরে উঠবে সোনার ধান, পরম আদরের ধান। শরৎ তাই আগামী ফসলের সম্ভাবনার বাণী। মাঠে মাঠে নবজীবনের আশ্বাস। বর্ষায় যে বীজ বপন, হেমন্তে যে পাকা ফসলের পরিণত-প্রতিশ্রুতি, শরতে তারই পরিচর্যা। অনাগত দিনের স্বপ্ন-সম্ভাবনায় তার নম্র নেত্রে খুশির ঝিলিক। এরই ওপর কৃষি-প্রধান বাংলাদেশের আয়-ব্যয়ের হিসাব রচিত হয়। তাই অর্থনৈতিক প্রবাহে শরৎ ঋতুরও রয়েছে এক অপরিহার্য ভূমিকা।

শারদীয় সাহিত্য :

বাঙালির জাতিয় উৎসবকে স্মরণীয় ও সার্থক করে তোলার জন্য বাঙালি কবি সাহিত্যিকের দল তাঁদের বরণীয় রচনা-সম্ভারে পরিপূর্ণ করে তোলেন সংবাদ-সাময়িকীর শারদ সংখ্যাগুলো। অত্যন্ত পরিশ্রমে তাঁরা পাঠক-পাঠিকাদের কাছে তুলে দেন তাঁদের নতুন নতুন সৃষ্টি। তাঁদের নব নব ভাবনাচিন্তার ফসল পাঠক-মন পরিতৃপ্ত হয়। রূপে-রসে রঙে-বৈচিত্র্যে মাখামাখি শারদসংখ্যাগুলোর এসময়েই আবির্ভাব। এগুলোও শারদ-উৎসবের এক অনন্য সম্পদ।
উপসংহার:
জগতে কিছুই স্থায়ী নয়। শরতের প্রসন্ন বর্ণবৈভবও একদিক স্তিমিত হয়ে পড়ে। আনন্দমুখর উৎসব-সমারোহ থেমে যায়। কালচক্রের আবর্তনে শুধুই পট-পরিবর্তন। এবার শরৎ-বিদায়ের লগ্ন আসে এগিয়ে। শিশির বিছানো, শিউলি-ঝরা পথের ওপর দিয়ে কখন যে নিঃশব্দে চলে গেছে। পথে পথে রেখে গেছে ম্লান, ঝরা শেফালি, বিষণ্ণ কাশের গুচ্ছ, আর মাঠভরা নতুন ধানের মুঞ্জরি। বিসর্জনের বেদনায় আমাদের মন ব্যথাতুর হয়ে ওঠে। অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে তার বিদায়-পথের দিকে চেয়ে থাকে এই বাংলার মাঠ-প্রান্তর, পশু-পাখি, মানুষ তরুলতা। মনের কোণে জমে থাকে বিদায় মুহূর্তের বিষণ্ণতা। সর্বত্রই উৎসব শেষের অশ্রুবিধুর আকুলতা। শরৎ যে আমাদের প্রাণের ঋতু! আমার প্রিয় ঋতু। এ ঋতু চক্রের মহিমায় বাংলাদেশ চিরকাল অপূর্ব সুখ, সৌন্দর্য ও শান্তির নিকেতন।
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।’
শুধু জননী জন্মভূমি রূপেই নয়, রূপসী বাংলার এই ষড়ঋতু নানা বর্ণ-গন্ধ গানের সমারোহে নিত্য-আবর্তিত হয়ে চলে। কিন্তু শহরবাসী ও শহরমুখী বাঙালি আজ আর অন্তরে অনুভব করে না তার সাদর নিমন্ত্রণ। ঋতু-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি যখন বিবাহের কণ্যার মতো অপরূপ সাজে সেজে উঠবে বাঙালি তখন শুনবে কলকারখানার যন্ত্রঘর্ঘর-ধ্বনি কিংবা কম্পিউটারে অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত থাকবে সওদাগরি অফিসে।