রচনা: পল্লী উন্নয়ন

রচনা: পল্লী উন্নয়ন
Admin June 22, 2024 85

ভূমিকা:

‘লাগলে মাথায় বৃষ্টি বাতাস
উল্টে কি যায় সৃষ্টি আকাশ
বাঁচতে হলে লাঙ্গল ধর রে
আবার এসে গাঁয়।’
-শেখ ফজলুল করিম।

হরিতে-হিরণে, সবুজে-শ্যামলে, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ- যার মূলভিত্তি ‘ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলো’। প্রায় বিরানব্বই হাজার গ্রাম (বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী) নিয়ে গঠিত এই দেশের শতকরা ৭৭ জন১ লোক পল্লাীগ্রামে বাস করে। পল্লীর সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা রূপ নিয়ে কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল-
‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন
মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন’

কিন্তু পল্লীর সে-সৌন্দর্য এখন আর দেখা যায় না, আমাদের অবহেলার কারণে পল্লীগ্রামগুলো আজ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। মানুষ কেবলই- ‘ইটের পর ইট মাঝে মানুষ-কীট, নেইকো ভালোবাসা নেইকো মায়া’- এমনি কৃত্রিম সুখের অন্বেষণে শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ কৃষিনির্ভর এই দেশের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়, যদি না পল্লীর উন্নয়ন হয়। পল্লীর উন্নতি মানে দেশের উন্নতি।

পল্লী উন্নয়ন কী:

পল্লী উন্নয়ন বলতে পল্লীর উৎপাদন বৃদ্ধি, সম্পদের সুষম বণ্টন ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য এক পরিকল্পিত পরিবর্তনকে বুঝায়। আজকের বাংলাদেশে পল্লী উন্নয়নের নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ ভিত্তহীনদের, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ মহিলা ও শিশুদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম করা। এবং সে নিয়ন্ত্রণের ফলশ্রুতি হিসেবে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার যথাযথ বণ্টন।

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি:

 পল্লী উন্নয়নের একটি নবতর পদ্ধতি বা পল্লী উন্নয়নে সাম্প্রতিক ভাবনা : দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী গ্রামে বাস করে। তাই দেশের অর্থনীতি এখনও গ্রামীণ মানুষের সার্বিক কৃষি ও অন্যান্য কর্মের ওপর নির্ভরশীল। দেশের উন্নয়ন করতে হলে আমাদের গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়ন করতে হবে। অন্যদিকে দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগণ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করছে। গ্রামীণ জনগণ প্রায়ই বিভিন্ন অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং অনেক সময় অকাল মৃত্যুর কবলে পড়ে অল্প বয়সে পৃথিবীর সম্ভাবনাময় জীবনের ইতি টানছেন। অপরদিকে শিক্ষার নিম্নহার আমাদেরকে বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে দারুণভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব যখন কম্পিউটার জগতে প্রবেশ করে অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা এখনও গণ স্বাক্ষরতা কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। তাছাড়া প্রতি বছর প্রাকৃতিক দূযোগ ব্যাপক হারে গ্রামীণ জনগণের জানমালের ক্ষতি করছে। ফলশ্রুতিতে আমরা বিশ্ববাসীর জীবন মানের তুলনায় বিরাট অসম দূরত্বে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছি। এ লক্ষে পরনির্ভরশীরতা কাটিয়ে পারিবারিক পর্যায়ে পরিবারকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত পূর্বক গ্রামের সব পরিবারের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নসহ গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন সমতালে এগিয়ে নেয়ার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সম্পদ আহরণের মাধ্যমে এবং গ্রামীণ জনগণের জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ছোট ছোট তৃণমূল পরিকল্পনার ভিক্তিতে পারিবারিক ও গ্রামীণ উন্নয়নের বিকাশ সাধনই পল্লী উন্নয়নের সাম্প্রতিক ভাবনা।

প্রাচীন-পল্লী:

‘চাষী ক্ষেতে চালাইতে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার।
তারি’পরে ভার দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।’
-রবীন্দ্রনাথ।

প্রাচীন পল্লীর এই ছিল রূপ। আদিকাল থেকেই পল্লীগ্রাম ছিল দেশের প্রাণকেন্দ্র। পল্লীবাসী মানুষের ছিল গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর-ভরা মাছ, গলায় গলায় গানের সুর, কুটিরশিল্পের প্রচলন। ঢাকার মসলিন কাপড় ও জামদানি শাড়ি তৎকালীন মোগল বাদশাহের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, কুমিল্লার হুক্কা ও খদ্দর-কাপড়, ময়নামতির ছিট কাপড়, পল্লীর নকশীকাঁথাও তৎকালীন ঐতিহ্য বহন করেছিল।

বর্তমান-পল্লী:


বড় দুঃখ, বড় ব্যথা সম্মুখেতে কষ্টের সংসার,
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
-বন্দে আলী মিয়া

গ্রামের সেই সহজ-সরল চিত্রপঠ এখন আর নেই। দিন বদলের পালায় বদলে যাচ্ছে অনেক কিছুই। সর্বগ্রাসি বিশ্বায়নের এই যুগে বদলে যাচ্ছে মানুষের রুচি, অভ্যাস, পোষাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড, পেশাসহ অনেক কিছুই। গত এক বা দুই যুগের ব্যবধানে শুধু যে রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্যান্য শহরের চাকচিক্য ও জৌলুশ বেড়েছে তাই নয় গ্রাম পর্যায়ে আরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর আমাদের ঘরের চালে লাউ-কুমড়োর সবুজ লতানো গাছপাতা শোভা পায় না। কোনো গ্রামে ছায়াঘেরা মাটির দেয়াল তোলা ছনের ঘর চোখে পড়ে না। প্রায় সব গ্রামেরই চোখে পড়বে পাকা দালান-কোঠা। গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে। ফ্রিজ, টিভি এখন ঘরে ঘরে। খাওয়ার পানির জন্য গ্রামের বাড়িতে আগে ছিল পাতকুয়ো এবং ইদারা, আজ তা নিশ্চিহ্ন। সে স্থান দখল করে নিয়েছে নলকূপ। গত শতক নাকি চিহ্নিত হয়েছে প্রযুক্তির উন্নয়ন, প্রসার ও ব্যবহারের জন্য। তার ঢেউ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যে লাগে নি তা নয়। বেশ ভালোভাবেই লেগেছে। তার মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বেড়েছে আশ্চর্যজনকভাবে। গ্রামেগঞ্জে যার তার হাতেরই এই ফোন। এটা ছাড়া কারোই দিন চলছে না। চাষাবাদ, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দেশ-বিদেশে থাকা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা সকল ক্ষেত্রেই চলছে মোবাইলের ব্যবহার। গ্রামীণ জীবনের অচলায়তন ভাঙতে এই মোবাইলের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বিচার বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। দক্ষিণ বাংলায় যেখানে বিদ্যুৎ যায় নি সেখানে দেখা যাচ্ছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল, রহিম আফরোজ, গ্রামীণ শক্তি এসব প্যানেল বিক্রি করছে। আরেকটা বড় মানসিক পরিবর্তনের কথা না বললেই নয়। সেটা হল স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা। গ্রামের দরিদ্ররা আজ কোনো না কোনোভাবে একটা কাজ খুঁজে নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছ। গ্রামেগঞ্জে এখন নানারকম কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। হাঁস-মুরগী পালন, ছাগল-গরু পালন, মাছ চাষ, নানা উন্নত জাতের কৃষি ফলনসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে গ্রামীণ জনগণ এখন নিজ প্রচেষ্টায়ই স্বাভলম্বী হতে শুরু করছে। স্ব-নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। শহরের মানুষ বাসার জন্য গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের খুঁজত ’কাজের ছেলে’ বা ’কাজের মেয়ে’ হিসেবে নিয়োগের জন্য। আজকাল তেমন কাউকে পাওয়া মুশকিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে শহর ও গ্রামের মধ্যে ব্যবধান অনেকটাই কমে আসছে। এখন নব্য ধনীক শ্রেণী ও যুবক শ্রেণী গ্রামের ক্ষমতা কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। পূর্বে গ্রামের বয়স্ক মাতব্বর এই ক্ষমতা কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করত। গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষালাভের আগ্রহ বাড়ছে এবং তারা শিক্ষিত হচ্ছে। এভাবে নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ও পরিবর্তন ধারা অব্যাহত আছে।

পল্লী উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বা জাতীয় উন্নতিতে পল্লীর গুরুত্ব:

আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মূল উৎস পল্লী। পল্লী উন্নয়ন ব্যতীত দেশের সর্বমুখী বা সর্বজনীন কল্যাণ সম্ভব নয়। পল্লীর অবস্থান ও উন্নয়নের উপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। তাই পল্লীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে হবে। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্যে যেসব উপকরণ প্রয়োজন, পল্লীতে তার কোনো অভাব নেই, অভাব শুধু যুগোপযোগী শিক্ষা, আদর্শ ও কর্মপ্রেরণার। পল্লী সব সময়েই উন্নয়নযোগ্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে পল্লীর সামগ্রীক উন্নয়নসাধন সম্ভব। তাই কবিগুরুর সাথে তাল মিলিয়ে বলতে পারি-
“ফিরে চল ফিরে চল মাটির টানে।”

পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পণা:

পল্লীর ভাগ্য উন্নয়নের মাঝেই সার্বিক উন্নয়ন নির্ভরশীল একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ উন্নয়ন- কাজে অগ্রসর হতে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পল্লীবাসীকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। সকল সময় সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে চলবে না। আত্মশক্তির উপর ভরসা করেই আমাদেরকে পল্লী-উন্নয়ন কাজে অগ্রসর হতে হবে। উন্নয়নের প্রতিটি ব্যবস্থা যাতে ধীরে ধীরে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে, তার জন্যে সুষ্ঠু পরিকল্পণা গ্রহণ করতে হবে।

পল্লী উন্নয়নের উপায় ও গৃহীত উদ্যোগ:

বাংলাদেশে পল্লী উন্নয়নের চাবিকাঠি হল : (ক) দারিদ্র্য দূরীকরণ, গ্রামীণ দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, (খ) আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন, (গ) ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, (ঘ) পরিকল্পনা প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন, সুযোগ সুবিধার অংশীদারিত্ব, পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির মূল্যায়নে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ; (ঙ) অপ্রতুল সম্পদের ব্যবহার ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রামীণ জনগণকে অধিকতর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান। তাই সঠিক কর্মসূচি নিয়ে গ্রামে জনগণের উন্নতিকল্পে এগিয়ে যেতে হবে। এ লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেয়া যায়:

পল্লী উন্নয়নের উপায়:


(১) শিক্ষার ব্যবস্থা:
‘এই বড় মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা,
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।’
গ্রামের মানুষের জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পল্লীর অনগ্রসরতার মূল কারণ অশিক্ষা ও কুশিক্ষা।

(২) স্বাস্থ্য উন্নয়ন: পল্লীর ৭৫% শিশু অপুষ্টির শিকার। বছরে ত্রিশ হাজারেরও বেশি শিশু অন্ধত্বের কবলে পড়ে, লাখ লাখ শিশু মারা যায় ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার আক্রমণে। অধিকাংশ গ্রামে রয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সমস্যা। সাম্প্রতিক কালে গ্রামে গ্রামে আর্সেনিক দূষণ গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যরক্ষার মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত স্বাস্থ্য শক্তিশালী- জাতি গঠনে সহায়ক- এ সত্যকে সামনে রেখে পল্লীর জনস্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং এর জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

(৩) কৃষি উন্নয়ন: বাংলাদেশের পল্লীজীবন কৃষিভিত্তিক। বর্তমান যুগের আধুনিক স্বয়ংক্রিয় কৃষিব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে আমাদের দেশে কৃষকদের অধিক খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন করতে হবে।

(৪) কুটিরশিল্পের উন্নয়ন: কুটিরশিল্পের মাধ্যমে গ্রামের বেকারদের কর্মসংস্থান করতে হবে। কুটিরশিল্পক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাহায্যের হাত সরকারকে প্রসারিত করতে হবে। কারণ, গ্রামবাসীর অগ্রগতিই দেশের অগ্রগতি।

(৫) যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: যাতায়ত ও মালামাল পরিবহনের জন্যে রাস্তাগুলোর সংস্কার সাধন ও পর্যাপ্ত নতুন রাস্তা নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে।

(৬) মৎস্য চাষের ব্যবস্থা: গ্রামে অনেক হাজামজা পুকুর নালা ডোবা পতিত অবস্থায় আছে। এগুলো সংস্কার করে মাছ চাষের ব্যবস্থা করতে হবে।

(৭) পল্লী বিদ্যুতায়ন: পল্লীর জনগণের উন্নতির জন্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন একান্ত অপরিহার্য। আমাদের দেশের অধিকাংশ গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ-সুবিধা পৌঁছায় নি। তাই যত শীঘ্র সম্ভব প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে।

(৮) সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তোলা: গ্রামের জনগণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করে তাদেরকে সঞ্চয়ী করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয়ী ব্যাংক যেমন: গ্রামীণ ব্যাংক, সমবায় ব্যাংক প্রভৃতি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়াও-

(৯) ভূমিহীনদের পুনর্বাসন করা

(১০) কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা

(১১) সমবায় প্রবর্তন করা

(১২) প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও পরবর্তী পুনর্বাসন এবং

(১৩) সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হবে।

গৃহীত উদ্যোগ:

বর্তমান পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচিতে জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেসরকারি প্রচেষ্টা পল্লী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। পল্লীর বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর আর্থ- সামাজিক উন্নয়ন ঘটানোর জন্যে কৃষি, গবাদি পশু পালন, সমবায়, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণ, গণসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রম এ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। সর্বোপরি উপর্যুক্ত আলোচনায় পল্লী উন্নয়নের জন্যে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে সরকার ইতোমধ্যে সবকটি পদক্ষেপই নিয়েছেন, তন্মধ্যে-

১. গ্রামে শিক্ষাবিস্তারের জন্যে স্কুল-কলেজের ব্যবস্থা করেছেন।
২. বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, গণশিক্ষা, সর্বজনীন শিক্ষা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বায়স্কশিক্ষা, অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন।
৩. গ্রামীণ অর্থনীতিকে সবল করার জন্যে সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
৪. কুটিরশিল্পের উৎকর্ষ বিধানের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দান ও মূলধন সরবরাহ করা হচ্ছে।
৫. কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে।
৬. জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে নানাধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
৭. জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত মোকাবিলায় এবং বেকার-সমস্যা সমাধানে নানাধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
৮. যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুতায়ন, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাপল্পে নানাধরনের প্রক্রিয়া অব্যাহত হয়েছে।
৯. ঋণের ব্যবস্থা করেছেন।
১০. গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮০ মে. টন চাল ব্যয়ে ৯৪ হাজার ১৭০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন।

পল্লী উন্নয়নের জন্যে সরকারের এভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে পল্লীর জীবনে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। বিংশ শতাব্দীর গ্রামকে আর অবহেলিত বলা চলে না, একবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে শহর আর গ্রামের পার্থক্য নির্ণয় করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে- যা আমাদের সবার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনও বহুবিধ সমস্যা ও বাধা রয়ে গেছে।

পল্লী উন্নয়নের সমস্যা:

পল্লী উন্নয়ন প্রয়াস সম্পর্কিত অতীত অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ থেকে বড় ধরনের বেশ কিছু সমস্যাকে চিহ্নিত করা যায়, যেগুলি সকল প্রয়াসের সফল সম্পাদনকে ব্যাহত করে আসছে। এসব সমস্যা হচ্ছে: ১. পল্লী উন্নয়ন সংস্থাসমূহের অস্থায়িত্ব, ২. অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্ব, ৩. কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক স্থানীয় সরকারগুলোকে অসহযোগিতা, ৪. একটা সুবিন্যস্ত পল্লী উন্নয়ন নীতিমালার অভাব, ৫. পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প থেকে উদ্ভূত সযোগ-সুবিধার অসম বণ্টন, ৬. প্রাকৃতিক ও লব্ধ সম্পদের সীমাবদ্ধতা, ৭. পল্লী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনায় উচ্চশ্রেণীর আধিপত্য এবং অসহায়ক এক গ্রামীণ সমাজ।

বাংলাদেশের পল্লীর আর্থসামাজিক বুনিয়াদের প্রকৃতিই পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির কার্যকর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দেখা দেয়। সেসব বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- পুঁজি গঠনের নিম্নস্তর, কৃষি নির্ভর অর্থনীতি, নিপুণ ও শিক্ষিত জনশক্তির অভাব, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, বিদেশি সহায়তার উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গ্রাম্য রাজনৈতিক দলাদলি, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনুন্নত বাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ।

একবিংশ শতাব্দীর পল্লী উন্নয়ন চিন্তা:

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে বিপর্যয়ের সম্মূখিন। এ দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী বিশ্বের দরিদ্র দেশসমূহের মধ্যে দরিদ্রতম এবং বেশির ভাগ জনসংখ্যা মূলত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে অপরিকল্পিত এবং মাত্রাধিক্য ব্যবহারের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ ব্যাপক ক্ষতির স্বীকার হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ এবং শষ্য উৎপাদনের জন্য মাটির উর্বরতা কিংবা উৎপাদনশীলতা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। আর স্বয়ংসম্পন্ন কৃষি ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করছে গ্রামীণ উন্নয়ন। এ জন্য একবিংশ শতাব্দীর পল্লী উন্নয়ন চিন্তা ভাবনায় কৃষিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ লক্ষে মাটির উপাদন, এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণের প্রতি জোড় দেয়া হচ্ছে।

আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য:

গ্রামে সহস্র অভাব, এই ভেবে গ্রাম ত্যাগ করলে চলবে না। গ্রামের মানুষকে ফিরে যেতে হবে গ্রামে এবং গড়তে হবে কলুষমুক্ত গ্রাম। সমস্যা এড়িয়ে গেলে সমস্যার সমাধান হয় না। গ্রামের উন্নয়নকে নিজের মনে করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রবল প্রচেষ্টায় গ্রামের হৃতশ্রী পুনরুদ্ধার সম্ভব।

উপসংহার:

দেশের পঙ্গু অর্থনীতিকে সজীব ও জীবন্ত করে তুলতে হলে গ্রামকে সজীব করে তুলতে হবে। ’গ্রামই দেশের প্রাণ’ এটা ভুলে গেলে চলবে না। ড. লুৎফর রহমান বলেছেন- ‘জাতিকে বড় করতে হলে পল্লীর মানুষকে প্রথমে জাগাতে হবে।’ গ্রামের উন্নতি ও দেশের উন্নতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আশা করা যায়, অচিরে আমাদের সরকার ও সচেতন দেশবাসীর সক্রিয় সহযোগিতায় গ্রামগুলোকে আমরা ‘সোনার গ্রাম’ হিসেবে দেখার সুযোগ পাব। তখন আমরা অতি আনন্দে নিমন্ত্রণ করবে-
“তুমি যাবে ভাই
যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোট গাঁয়?”