রচনা: ঐতিহাসিক লালবাগের কেল্লা

রচনা: ঐতিহাসিক লালবাগের কেল্লা
Admin June 29, 2024 197

ভূমিকা:

আমাদের জীবনযুদ্ধ শুধু আমাদেরকে যান্ত্রিকতাই শিখিয়েছে। কিন্তু তবুও আমাদেরকে অতীত ঐতিহ্যকে স্মরণ করতে হবে বৈকি। নিজেদের জন্য না হলেও আমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য। তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা, মহাস্থানগড়, শালবন বিহার, ঢাকার লালবাগের কেল্লা এমন অনেক ঐতিহাসিক কীর্তি ও স্থাপত্য সম্পর্কে আমাদের পরবর্তী বংশধরদের অবশ্যই সম্যক ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। 

লালবাগ:

ঢাকার লালবাগের কেল্লা ইতিহাসের এক অভাবনীয় নিদর্শন। দেশ-বিদেশের বহু মানুষ দূর পথ পাড়ি দিয়ে আসেন এই কীর্তি দেখতে। অথচ আমাদের অনেকেই হয়তো এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য সম্পর্কে কিছু জানে না। 

ইতিহাস:

লালবাগের কেল্লার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হল ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীর ইসলাম খানকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করেন। তিনি ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে রাজমহল হতে শাসন কেন্দ্র ঢাকায় স্থানান্তর করেন। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খান বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন এবং ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে হতে শাসন কার্য শুরু করেন। তখনও ইমারত বা দালানের প্রচলন হয়নি। নবাব শায়েস্তা খান তখন নিজেই কাঠের বাংলোতে থাকতেন। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের শেষে দিকেই শায়েস্তা খান দালান তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে লালবাগ কেল্লার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। ঐ বছরই আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা আযম শাহ বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন। ১৬৭৭-৭৮ সালে এই লালবাগ কেল্লার নির্মাণের কাজ তিনি শুরু করেন। তার পিতার নামানুসারে প্রথমে তিনি এর নামকরণ করেন ‘আওরঙ্গবাদ দুগাঁ’। ১৬৭৯ সালে দুর্গের কাজ অসমাপ্ত রেখেই তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খাঁ দ্বিতীয়বার বাংলার সুবেদার হলে তিনি এই লালবাগ দুর্গের কাজ অনেকটা এগিয়ে নেন। কিন্তু, পরবর্তীতে তার অতি প্রিয় কন্যা পরীবানুর আকস্মিক মৃত্যুতে অমঙ্গলের ইঙ্গিত মনে করে দুর্গ নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেন। পরীর মত রূপ ছিল বলে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল পরীবানু। এই পরীবানু সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আযমের স্ত্রী ছিলেন। শায়েস্তা খান তাঁর কন্যাকে খুবই ভালবাসতেন। তাই তিনি তাঁর কন্যার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য দুর্গের ভিতরে কবরের উপর একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করেন। 

অবস্থান:

প্রায় সোয়া তিনশ বছর হল ঐতিহাসিক লালবাগের কেল্লা আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে লালবাগ রোড ও রিয়াজউদ্দীন রোডের মাঝখানে লালবাগ কেল্লা অবস্থিত। এক সময় বুড়িগঙ্গা এই দুর্গের একেবারে পাশ দিয়েই প্রবাহিত হত। যদিও এখন কিছুটা সরে গিয়েছে। 

কেল্লার উত্তরে দু’টি এবং দক্ষিণে একটি বিশাল গেইট। পশ্চিমের গেইট সবসময় জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে। দুর্গের ভিতরে লাল ইটের সুন্দর রাস্তা। এর চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। বিভিন্ন গাছ-গাছালি কেল্লার সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করেছে। 

মাজার:

প্রবেশ দ্বারের সোজাসুজি রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র স্থাপত্য কীর্তি যাতে ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন দুর্লভ পাথর। এটিই নবাব শায়েস্তা খানের কন্যা পরীবানুর মাজার। এ মাজারটিতে মুসলিম ও হিন্দু স্থাপত্যের এক অপরূপ সংমিশ্রণ ঘটেছে। জানা যায় এ মাজারের জন্য ভারতের রাজমহল হতে কালোপাথর, চুনাপাথর, জয়পুর হতে সাদা মার্বেল পাথর সংগৃহীত হয়েছিল। মাজারটি বর্গাকৃতির। প্রতিটি পাথরই ৬০ ফুট দীর্ঘ এবং প্রত্যেক দিকেই তিনটি করে দরজা রয়েছে। বিভিন্ন রংয়ের সুশোভিত মন্দির স্থাপত্যের অনুকরণে পাথরের উপর চাপিয়ে সর্বমোট ১৩টি স্তরে মাজার তৈরি করা হয়েছে। মাজারের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ছাদের মাঝখানে একটি কৃত্রিম গম্বুজ এবং তার উপরে একটি পানফুল স্থাপিত হয়েছে। মাজারের বাইরে দক্ষিণে আরও কয়েকটি কবর রয়েছে। অনেকের মতে, এগুলো পরীবানুর ভাই বোনেদের কবর। 

দরবার হল:

মাজারের পূর্বে দরবার হল এবং সাথের আম্বরটি শাহজাদা আযম খান নির্মাণ করেন। আম্বরটির ভিতরে একটি চৌবাচ্চা ও একটি ঝর্ণা রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এ সকল নিদর্শন তৎকালীন নবাবদের সৌন্দর্য পিপাসু মন মানসিকতার পরিচায়ক। দুর্গের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় স্থাপত্য হচ্ছে দুর্গের দক্ষিণের গেইট। তিন তলাবিশিষ্ট এ গেইটের সম্মুখভাগে সুউচ্চ মিনার শোভা বর্ধন করছে। বাংলাদেশের একশত টাকার নোটে এই গেইটের ছবিটিকেই দেখা যায়। 

অন্যান্য:

এ ছাড়াও দরবার হলের পূর্বদিকে রয়েছে ২৩৫ ফুট দীর্ঘ বর্গাকৃতির পুকুর। পুকুরের চারধার লাল ইট দিয়ে বাঁধানো। দুর্গের মাঝখানে ৬৭টি ফোয়ারা রয়েছে। এটি মোগল সম্রাটদের সৌখিনতার নিদর্শন। জানা যায়, এ ফোয়ারার জন্য বুড়িগঙ্গা হতে পানি আনার উদ্দেশ্যে প্রায় ২৩টি ঘূর্ণায়মান চাকার সাহায্য নেয়া হত। 

দুর্গের সোজা পশ্চিমে আছে চর গম্বুজ শোভিত একটি চমৎকার মসজিদ। ৬৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ৩২ ফুট প্রস্থের এ মসজিদটি সম্পূর্ণ ইট-সুড়কির তৈরি। ভিতরের দেয়ালে ফারসিতে অনেক বয়ান খোদাই করা। মসজিদ, পুকুর, মাজার দরবার হল, এ’সবই একই সারিতে অবস্থিত। দুর্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে দুর্গের প্রতিরোধ প্রাচীরের গা ঘেঁষে ভিতরে অনেকগুলো কক্ষ। এ কক্ষবা ঘরগুলোর নকশা খুবই জটিল। এর মধ্য দিয়েই অনেকগুলো গোপন পথ বিভিন্ন দিকে প্রসারিত ছিল। বর্তমানে কক্ষগুলোর ভিতরের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

উপসংহার:

সভ্যতার নিদর্শন কালের সাক্ষী এই লালবাগ দুর্গ এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। মুঘল আমলের এ স্থাপত্য নিদর্শন আজও আমাদের মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের কথা।