রচনা: ইন্টারনেট

রচনা: ইন্টারনেট
Admin June 26, 2024 117

ভূমিকা:

মানবসভ্যতার বিস্ময়কর বিকাশে বিজ্ঞান যে অনন্য ভূমিকা পালন করছে তার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ইন্টারনেট। বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী একটি ব্যবস্থার নাম ইন্টারনেট। ইন্টারনেট কম্পিউটার বাহিত এমন একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে বিশ্বের দেশগুলো আজ পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ‘বিশ্বায়ন’ ধারণায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই ইন্টারনেট। জীবনের ব্যাপক ও বহুমুখী কাজে এখন ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয়ে আধুনিক ইলেক্ট্রনিক্স প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণে বিপুলভাবে সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় তথ্যবিপ্লবেও রয়েছে ইন্টারনেটের গুরুত্বপূর্ণ ও সফল অবদান।

তথ্যবিপ্লব ও তথ্যপ্রযুক্তি:

তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার এ যুগে খুব জোর দিয়েই বলা যায়, ‘Information is power.’ জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি তথ্যসমৃদ্ধ হওয়া শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্প বিপ্লবের পর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন পৃথিবীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তথ্যপ্রযুক্তি দূরকে এনেছে চোখের সামনে, পরকে করেছে আপন, আর অসাধ্যকে সাধন করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ও চর্চা এখন শুধু হাতে গোনা দু-একটি উন্নত দেশের আভিজাত্যের বিষয় নয়, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।


ইন্টারনেট কি:

ইন্টারনেট কথাটি ইন্টারকানেক্টেড নেটওয়ার্ক এর সংক্ষিপ্ত রূপ। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটের উদ্ভব। কম্পিউটার নেটওয়ার্কের একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছে এ প্রক্রিয়া। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত কম্পিউটারকে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে যুক্ত করে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাই হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের সাথে অন্যান্য কম্পিউটার সংযুক্ত রয়েছে এ পদ্ধতিতে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন কম্পিউটার থেকে যে কোনো কম্পিউটারে ছবিসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ও প্রেরণ করা যায়। ইন্টারনেট চালানোর জন্য সাধারণত তিনটি জিনিস প্রয়োজন, এগুলো হলো : কম্পিউটার, মডেম এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার।

ইন্টারনেটের সম্প্রসারণ:

আমেরিকার প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষ চারটি কম্পিউটারের মাধ্যমে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করেছিল তার নাম ছিল ‘আর্পানেট’। পরবর্তী তিন বছরে কম্পিউটারের সংখ্যা বেড়ে ছত্রিশে দাঁড়ায়। চাহিদা বাড়ার ফলে ১৯৮৪ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল সাইন্স-ফাউন্ডেশন সর্বসাধারণের জন্য ‘নেস্ফেনেট’ নামে একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করে। তিন বছরের মধ্যে এ ব্যবস্থা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এটি তখন গবেষণা কাজে তথ্য বিনিময়ে সীমাবদ্ধ ছিল। এর সঙ্গে অনেক ছোট বড় নেটওয়ার্ক যুক্ত হয়ে সমস্যার সৃষ্টি করে। সমগ্র ব্যবস্থাটি নিয়ন্ত্রণের জন্য ’৯০-এর দশকের শুরুতে কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্ক হিসেবে ইন্টারনেট গড়ে তোলা হয়। ১৯৯৩ সালে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য ইন্টারনেটকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। অল্পদিনের মধ্যে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হয় লাখ লাখ সদস্য। এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

ইন্টারনেটের প্রকারভেদ:

ইন্টারনেট প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত কতকগুলো পদ্ধতি রয়েছে সেগুলো নিচে দেয়া হলো :

১. ই-মেইল : ই-মেইলের মাধ্যমে যে কোনো সংবাদ পাঠানো যায়। এ প্রক্রিয়ায় খুব দ্রুত অর্থাৎ ফ্যাক্স-এর দশভাগের একভাগেরও কম সময় এবং কম খরচে তথ্যাদি পাঠানো যায়।
২. ওয়েব : ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত কম্পিউটারগুলোতে যে তথ্য রাখা হয়েছে সেগুলো ব্যবহার করার ব্যবস্থা বা পদ্ধতিকে ওয়েব বলে।
৩. নেট নিউজ : উন্টারনেটের তথ্যভাণ্ডারের সংরক্ষিত সংবাদ যে কোনো সময় এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উন্মুক্ত করা যায়।
৪. চ্যাট : এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একাধিক ব্যক্তির সাথে একই সময়ে কথা বলা যায় বা আড্ডা দেয়া যায়।
৫. আর্কি : আর্কির কাজ হলো তথ্যসমূহকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সূচি আকারে উপস্থাপন করা।
৬. ইউজনেট : অনেকগুলো সার্ভারের নিজস্ব সংবাদ নিয়ে গঠিত তথ্যভাণ্ডার, যা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।
৭. গোফার : তথ্য খুঁজে দেয়ার একটি পদ্ধতি, যার সাহায্যে গুরুত্বানুযায়ী তথ্যের সমন্বয় সাধিত হয়।
৮. ই-ক্যাশ : ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ই-ক্যাশ পদ্ধতি বলে। আসলে ই-ক্যাশ অনেকগুলো আধুনিক অর্থনৈতিক লেনদেনের সমষ্টি।

বাংলাদেশের ইন্টারনেট:

বাংলাদেশে ইন্টারনেট চালু হয় ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন এর ব্যবহার ছিল সীমিত এবং কেবল ই-মেইলে তার প্রয়োগ ছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ জুন থেকে অনলাইন সংযোগ দেয়া শুরু হলে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির বিশাল জগতে প্রবেশ করে। ২০০০ সালের শুরুতে এর ৬০ হাজার সংযোগ দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে তা ক্রমাগত বাড়ছে। ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশে ফাইবার অপটিক কেবল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ বড় শহরগুলোকে সংযুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়। ঢাকার মগবাজার ও গুলশানের টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মধ্যে প্রথম ফাইবার অপটিক সংযোগ স্থাপন করা হয়। বর্তমানে শহরগুলোতে আন্তঃএক্সচেঞ্জগুলোর মধ্যে ফাইবার অপটিক সংযোগ আছে।

তথ্যবিপ্লবে ইন্টারনেট:

তথ্যবিপ্লবে ইন্টারনেট যুগান্তকারী বিপ্লব এনেছে। ইন্টারনেট চোখের পলকে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় তথ্য পাঠাতে বা তথ্য এনে দিতে সক্ষম। লেখাপড়া, শিক্ষা, গবেষণার ক্ষেত্রে বাই অত্যন্ত জরুরি, যা সবসময় হাতের কাছে পাওয়া যায় না। এখন ঘরে বসেই বিশ্বের যে কোনো লাইব্রেরিতে প্রবেশ করা যায় এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করা যায়। ইন্টারনেট ভ্রমণবিলাসীদের জন্য বন্ধু স্বরূপ। এটি ভ্রমণ স্থানের আবহাওয়া, থাকার হোটেল রিজার্ভেশন, রেন্ট এ কার, প্লেনের টিকিট বুকিংয়ের ব্যবস্থা করে থাকে। ইন্টারনেট ডাক্তার বা চিকিৎসা ব্যবস্থাকে করেছে সহজলভ্য ও স্বল্প ব্যয়বহুল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ করা যায় পৃথিবীর ভালো ভালো চিকিৎসকদের সাথে। ফলে ঘরে বসেই পেতে পারি উন্নত চিকিৎসা। আইনগত পরামর্শ লাভের জন্য বা কোনো রেফারেন্সের প্রয়োজন হলে সেই আইনজীবী বা আইন ফার্মে ইন্টারনেট কমান্ড করলে তার তথ্যাদি ঘরে বসে পাওয়া সম্ভব। এতে সময়, অর্থ ও শ্রম বহুগুণে সাশ্রয় হয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো দেশের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মুহূর্তের মধ্যে জানা যায়। বিনোদন হিসেবে গান শোনা, সিনেমা দেখা, খেলা দেখা প্রভৃতি ঘরে বসেই সম্ভব ইন্টারনেটের কারণে। দৈনিক পত্রিকার খবর, শেয়ার বাজারের খবর, বাজারের হালচাল সবই জানা যায় এ প্রক্রিয়ায়।

বাংলাদেশের অবস্থান:

তথ্যপ্রযুক্তি যে বাংলাদেশের জন্যও সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি, এ কথা আজ সবাই উপলদ্ধি করছে। তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপারে খুবই আগ্রহ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, ইপিবি, বিসিসি, বিসিএস, নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশীদের সংগঠন ‘টেকবাংলা’ প্রভৃতি সংগঠন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, তথ্যপ্রযুক্তির প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ গত দশ বছরে এগিয়েছে। সম্প্রতি সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তথ্য প্রবাহের সাম্রাজ্য ইন্টারনেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তির উন্ননে করণীয়:

বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর সাথে উন্নত দেশগুলোর এক ধরনের বৈষম্য আলোচিত হচ্ছে। ইংরেজিতে একে বলা হচ্ছে Digital Divide, বাংলায় ডিজিটাল বৈষম্য। তাই একবিংশ শতাব্দীর এ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে হবে যোগ্যতা দিয়ে এবং তথ্যপ্রযুক্তির নবতর কৌশল আয়ত্তে এনে। এজন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

১. বিশ্বায়নের এ যুগে টিকে থাকতে হলে আমাদের দেশের তরুণ সমাজকে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।
২. যেহেতু বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে, সেহেতু বিশাল সংখ্যক গ্রামবাসীকে শিক্ষিত, সচেতন ও তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানে দক্ষ করে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং ইন্টারনেটের প্রসার ঘটাতে হবে।
৩. বিশ্বব্যাপী চলমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের অংশীদার হওয়ার জন্য জাতীয় তথ্য অবকাঠামো গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
৪. তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষ সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

উপসংহার:

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিই বর্তমান বিশ্বের সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূল হাতিয়ার। তথ্যপ্রযুক্তির দিক থেকে যারা যত বেশি অগ্রগামী, তারা তত বেশি উন্নত। বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতির ফসল ইন্টারনেট এখন পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে গ্রহান্তের কর্মকাণ্ডে নিজের স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের দেশের মতো আমরাও পিছিয়ে আছি। তাই আমাদের উচিত ইন্টারনেটের ব্যাপক ও বহুমাত্রিক প্রসার ঘটিয়ে দেশকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী করে গড়ে তোলা।