রচনা: দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটার

রচনা: দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটার
Admin June 26, 2024 124

ভূমিকা :

শিল্পবিপ্লবের পর থেকে যন্ত্রবিজ্ঞানের জয়যাত্রা অব্যাহত। বাষ্পশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি ও আণবিকশিক্তি যন্ত্রবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার নিত্য নতুন দ্বার দিয়েছে খুলে। ফলে সংখ্যাতীত আবিষ্কারের মধ্যস্থতায় মানুষ যন্ত্রশক্তিতে হয়েছে দুর্বার শক্তির অধিকারী। যন্ত্র আজ তার হাতের ক্রীড়নক। তার কর্মজীবনে বিজ্ঞানের বৃহত্তর ক্ষেত্রে অনুগত ভৃত্যের মতো হুকুম তালিম করতে যে যন্ত্র সদা ব্যস্ত তার নাম কম্পিউটার। আজকের দিনে তাই মানবসভ্যতা হয়ে পড়েছে কম্পিউটার-নির্ভর স্বয়ংক্রিয়তা-কেন্দ্রিক। কম্পিউটার বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী বিস্ময় ও আধুনিকতম আবিষ্কার।

কম্পিউটার কী? :

আভিধানিক অর্থে কম্পিউটার হল এক ধরনের গণক যন্ত্র। কিন্তু আজকাল কম্পিউটারকে কেবল গণনাকারী বলা চলে না। এখন তা এক ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ধারণা দেয় বা অগণিত তথ্য বা উপাত্ত গ্রহণ করে অত্যন্ত দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ, গণনা বিশ্লেষণ ইত্যাদি করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে পারে।

উদ্ভাবন ও ক্রমোন্নতি :

কম্পিউটার উদ্ভাবনের জনক হিসেবে খ্যাতির অধিকারী হলেন ব্রিটিশ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজ। তার পরিকল্পিত গণক যন্ত্রই কিম্পউটার নির্মাণের প্রেরণা যুগিয়েছে পরবর্তীকালে। ব্যাবেজের গণক যন্ত্রের মানকল্পনা ছিল অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে। এর প্রায় এক শতাব্দীকাল পরে ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিবিদ্যার মেলবন্ধনে মানুষের হাতে এল ইলেকট্রনিক যন্ত্রগণক। ল্যাটিন শব্দ ‘কম্পুটার’ থেকে ‘কম্পিউটার’ কথার উৎপত্তি। আধুনিক কম্পিউটারের সূত্রপাত হয়েছে ১৮৩৩ সালে।

কম্পিউটার ও তার কার্যকারিতা : কম্পিউটার আসলে এক ধরনের যন্ত্র মস্তিস্ক। কম্পিউটারের থাকে তিনটি সুস্পস্ট অংশ-
  1. সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট,
  2. ইনপুট,
  3. আউটপুট।
যে কোনো সমস্যা সংক্রান্ত সবরকম তথ্য নিয়ে কাজ করে সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট। ‘ইনপুট’ তথ্য সম্বলিত নির্দেশ প্রদান করে আর ‘আউটপুট’ প্রকাশ করে গণনা সম্বলিত ফল। যে যাবতীয় তথ্য নিয়ে কম্পিউটার কাজ করে, তাকে বলে ‘প্রোগ্রাম’। কম্পিউটারে তথ্য ও নির্দেশ প্রদানের জন্যে যে বিশেষ ভাষা ব্যবহার করা হয়, তাকে বলে ‘প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ’। আর এসব কিছুকে একত্রে অভিহিত করা হয় ‘কম্পিউটার সফ্টওয়্যার’ বলে। এছাড়া কম্পিউটারের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণকারী একটা কাঠামো থাকে, তাকে বলে ‘হার্ডওয়্যার’। কম্পিউটারের বড় উপযোগিতা হল তথ্য ও প্রোগ্রামের রদবদল বা সংযোজন ঘটিয়ে একই কম্পিউটারকে দিয়ে নানা রকম কাজ করা যায়। কম্পিউটার যে আজকের দিনে বিস্ময়কর ও বিশ্বস্তভাবে সবধরনের কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে তার মূলে রয়েছে এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য। যেমন :
  • অত্যন্ত দ্রুত গণনার ক্ষমতা।
  • বিপুল পরিমাণ উপাত্তকে সুসংবদ্ধভাবে যন্ত্র মগজে ধরে রাখার ক্ষমতা।
  • তথ্য বিশ্লেষণের নির্ভুল ক্ষমতা।
  • ‘ডাটা’ ও ‘প্রোগ্রাম’ অনুসারে কাজ করার ক্ষমতা।

কম্পিউটার ও আধুনিক জীবন :

কম্পিউটার আধুনিক যুগে মানুষের পরম নির্ভরশীল বন্ধু। কোটি কোটি সংখ্যার অঙ্ক মিলিয়ে নিয়োগ ক্যাশিয়ার কমিটির হাতে অতি অল্প সময়ে তুলে দিয়ে তাকে নিশ্চিত নির্ভাবনায় ঘরমুখো করিয়ে দিতে পারে – কম্পিউটার এখন বড় বড় কল – কারখানায় বসে উৎপাদনের পরিকল্পনা আর তা নিয়ন্ত্রণের খবরদারি করছে, লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করছে। রেলওয়ে, এয়ারলাইন্স, ব্যাঙ্ক রিসার্চ সেন্টার, ইনসিওরেন্স প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারের একচ্ছত্র আধিপত্য। পরীক্ষার ফল প্রকাশ, অপরাধীকে খুঁজে বের করা, পুরনো মামলার নথিপত্র খুঁজে তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া, বিজ্ঞাপন প্রচার করা এ সমস্তই এখন করছে মানুষের সৃষ্ট ঐ যন্ত্র-মগজ। কম্পিউটার চালিত ‘স্ক্যারার’ খুঁজে এনেছিল আটলান্টিক মহাসাগরে ভেঙ্গে পড়া বিমানের ‘ব্ল্যাকবক্স’। যে সব দুরূহ কাজ মানুষের অসাধ্য, যে সব দুর্গম স্থান মানুষের অগম্য সেখানেই কম্পিউটারের প্রয়োগ, আর সেখানে তার অকল্পনীয় সাফল্য। যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও কম্পিউটার নিয়েছে শিক্ষকের ভূমিকা। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সবই শেখাচ্ছে নিপুণ দক্ষতার সাথে। দাবা, ক্রিকেট, ফুটবলসহ নানারকম ভিডিও গেম খেলছে কম্পিউটার। এসব খেলায় কম্পিউটার মানুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। মুদ্রণ জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে কম্পিউটার। ইন্টারনেটের সাহায্যে ঘরে বসে মুহূর্তেই বিশ্বের যে কোন জায়গায় যে-কোন-তথ্য আদান-প্রদান করা যাচ্ছে। মানুষের অসাধ্য ও বিপজ্জনক কাজেও কম্পিউটার নিয়ে আসছে অকল্পনীয় সাফল্য। আধুনিক জীবনে কম্পিউটার তাই অপরিহার্য। একই কারণে সভ্যতায় কম্পিউটারের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশেও কম্পিউটারের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এদেশে এখন মূলত মুদ্রণ শিল্প, ব্যাঙ্ক-অফিস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশে কম্পিউটার ও কম্পিউটার শিক্ষা :

বাংলাদেশে কম্পিউটার ব্যবহারের সূচনা হয় ষাটের দশকে এবং নব্বই-এর দশকে তা ব্যাপকতা লাভ করে। ১৯৬৪ সালে আণবিক শক্তি কেন্দ্রে IBM 1620 সিরিজের একটি কম্পিউটার আনার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে বাংলাদেশে কম্পিউটারের পদচারণা শুরু হয়। কিন্তু আশির দশকের আগে এদেশে কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষার কোন সুযোগ ছিল না। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কম্পিউটার শিক্ষা শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে কম্পিউটারের দ্রুত ও ব্যাপক ব্যবহার ঘটছে। কম্পিউটার শিক্ষাও যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক কম্পিউটার শিক্ষার সূত্রপাত ঘটে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯২ সালের ১ সেপ্টেম্বর। বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কম্পিউটার শিক্ষার জন্য বিভাগ চালু করা হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৯৯১ সাল থেকে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৯৯৪ সাল থেকে কম্পিউটার শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বাংলা সফ্টওয়্যার উদ্ভাবন :

কম্পিউটারে প্রথম বাংলা লেখা সম্ভব হয় ১৯৮৭ সালে এবং এর সাফল্যের কৃতিত্ব মাইনুল ইসলাম নামক একজন প্রকৌশলীর। তিনি নিজের উদ্ভাবিত বাংলা ফন্ট ‘মাইনুললিপি’ ব্যবহার করে অ্যাপল-ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে বাংলা লেখার ব্যবস্থা করেন। মাইনুললিপির পর পরই ‘শহীদলিপি’ ও ‘জব্বারলিপি’ নামে আরও দুটো বাংলা ফন্ট উদ্ভাবিত হয়। এরপর ১৯৮৮ সালে আনন্দ কম্পিউটার্স নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে তৈরি হয় অ্যাপেল-ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে ব্যবহার উপযোগী প্রথম ইন্টারফেস ‘বিজয়’। এ সময়েই প্রথম বাংলা কি-বোর্ড লে-আউট তৈরি হয়। ১৯৯৩ সালে ফন্ট ও বাংলা কি-বোর্ডকে আই.বি.এম কম্পিউটারের আধুনিক অপারেটিং সিস্টেম ‘মাইক্রোসফ্ট উইন্ডোস’-এর সঙ্গে ব্যবহারের জন্য ইন্টারফেস ‘বিজয়’ উদ্ভাবিত হয়।

বাংলাদেশে কম্পিউটারের ব্যবহার :

কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহারের প্রভাবে ঢাকার অফিস ও প্রকাশনা শিল্পে দ্রুত কম্পিউটারের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর, ব্যাংক-বীমাসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা, সামরিক স্থাপনা ইত্যাদি সকলক্ষেত্রেই কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৯৯ সাল থেকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ক্রেডিট কার্ড। বর্তমানে কম্পিউটারভিত্তিক আর্থিক লেনদেনের এই নিরাপদ ও সহজসাধ্য ব্যবস্থা ক্রেডিট কার্ড সার্ভিসটি ভিসা, মাস্টার কার্ড ও বণিক নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদান করা হচ্ছে। ১৯৯৫ সাল থেকে বাংলাদেশে রপ্তানিযোগ্য সফ্টওয়্যার তৈরি উন্নয়ন এবং ১৯৯৭ সাল থেকে রপ্তানিযোগ্য মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু হয়।

কম্পিউটার ও বেকারত্ব :

বিজ্ঞানীদের চেষ্টার ফল এই যন্ত্রদানবের ক্ষমতা অপরিসীম। তাদেরই আশঙ্কা মানুষের সৃষ্টি এই যন্ত্রদানবকে দিয়ে কাজ করাতে করাতে এমন এক সময় আসবে, যখন কাজের ক্ষুধায় উন্মত্ত দানব স্রষ্টা মানুষকেই করবে ক্রীতদাস। কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে দেখলেই বাস্তব সত্যটা স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। কম্পিউটারের ব্যাপক প্রয়োগ ও ব্যবহার মানুষকে করবে সাময়িক কর্মহীন। যন্ত্র তখন মানুষের ক্রীড়নক না হয়ে মানুষ হবে যন্ত্রের ক্রীড়নক। এমনও হতে পারে যে, মানুষের কাজ কেড়ে নিতে বেকারের মিছিলে ভরে যাবে দেশ। কম্পিউটারের ব্যবহারে ইতোমধ্যে অফিসে, শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। অবশ্য অপরদিকে কম্পিউটার বহু নতুন নতুন কর্মও সৃষ্টি করছে। অপারেটর, প্রোগ্রামার, হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পদে বহু লোকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। এইভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কম্পিউটার সাময়িকভাবে কর্মশূন্যতা সৃষ্টি করলেও সামগ্রিকভাবে একটি বহুল কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করবে।

কম্পিউটারজনিত অন্যান্য সমস্যা :

একনাগাড়ে অনেকদিন কম্পিউটার চালালে, কিংবা মাত্রাতিরিক্ত কম্পিউটার ব্যবহারে চোখের ক্ষতি হতে পারে, মাথা ব্যথাসহ অন্যান্য শারীরিক উপসর্গও দেখা দিতে পারে। অনেকসময় ভাইরাস আক্রমণে অথবা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অথবা বৈদ্যুতিক গোলযোগে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে এসব বিষয় কম্পিউটার ব্যবহার ও প্রযুক্তিগত দিকের উপর নির্ভর করে।

উপসংহার :

বিজ্ঞানের আশীর্বাদ থেকে মানুষ পিছিয়ে থাকতে পারে না। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশলি দেশগুলোতে আজ আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার প্রবেশ অপরিহার্য। কম্পিউটারকেও আজ আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অনিবার্যভাবেই তার আগমন ঘটে গেছে সারা দুনিয়ায়। সেক্ষেত্রে দেশের অবস্থাকে স্বীকার করেই প্রয়োগ ক্ষেত্র নির্বাচন করতে হবে। এর প্রয়োগের মধ্য দিয়েই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে নতুন কর্মসংস্থানের উপায়। শতাব্দীর এই বিস্ময়কর আবিষ্কারটিই আজ বলে দেবে কোন পথে আমাদের সার্থকতা আর কোন পথে আমাদের অনগ্রসরতার কারণ। সেদিনের অপেক্ষায় আমরা আছি।