রচনা: বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ

রচনা: বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ
Admin June 27, 2024 78

সূচনা:

ঘুম-ভাঙ্গা ভোর থেকে শুরু করে ঘুম না আসা রাতের ঘোর পর্যন্ত জীবন ও জগতের অনিবার্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সৌন্দর্য যার মাধ্যমে অনায়াসে আমাদের আয়ত্তে আস, তাকেই এক কথায় বলতে পারি বিজ্ঞান। বিচিত্র বিশ্বের বিস্ময়কর বার্তাবাহী, মানুষের দেহ ও মনের সামগ্রিক পূর্ণতা দানকারী, জীবন ও জড়জগতের রহস্যরাজ্য উদ্ঘাটনকারী বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতি মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সুন্দরতম বিকাশের সর্বোচ্চ সোপানে পৌঁছে দিতে আজ সম্পূর্ণ সক্ষম। বিজ্ঞান তাই আজ আমাদের কাছে অনিবার্য আশীর্বাদ স্বরূপ ঠিকই কিন্তু তবু পাশাপাশি অস্তিত্ব-চেতনার অস্থি-মূলেই হেনে চলেছে অবিশ্বাস্য আক্রমণ, নিত্যদিন চলছে ধ্বংস আর মৃত্যুর মহামারণযজ্ঞের প্রচণ্ড প্রমত্ত প্রস্তুতি। শঙ্কিত মানবমনে তাই এ প্রশ্ন আজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে-বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ।

বিজ্ঞানের বিকাশ:

আদিমসমাজে প্রকৃতির আর পাঁচটি প্রাণীর মতোই মানুষ ছিল একান্ত অসহায়। জ্ঞানবৃক্ষের ফসল সেদিন সে সুন্দর করে তুলতে পারে নি। দিনে দিনে তার জ্ঞানান্বেষণ ও অক্লান্ত অনুশীলন তাকে আগুন থেকে আরম্ভ করে একে একে এনে দিতে শুরু করেছে নিত্য-নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্রতর বিশ্বের মুখোমুখি। জীব, জড় ও প্রকৃতিক অচেনা অদেখা, অজানা রহস্য আজ আশ্চর্যভাবে তার করায়ত্ত। প্রকৃতির প্রতি অসহায় আনুগত্যের বদলে সে আজ তার সার্বিক চেষ্টায় সফল হয়েছে স্বকীয় স্বরূপে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ, সুন্দর ও সুদৃঢ়ভাবে স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়াতে। কালে কালে পাল্লা দিতে শুরু করেছে খোদ এই প্রকৃতির সঙ্গেই। যে প্রকৃতির আবর্তে সে ছিল একদা অসহায় দাস, আজ আপন বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞান উদ্ভাবন, এক কথায় বিজ্ঞানের বলে সে আজ হয়ে উঠতে চাচ্ছে সর্বতোভাবে তারই প্রভু। বদ্ধঘরের বন্ধীবাসিন্দা আজ আর সে নয়-কবির কল্পনা বাস্তবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে- “ধাক্কা দিয়ে তারায় তারায় সূর্যে গিয়ে ঠেকবো রে”। আজ সে সত্যিই তারায় তারায় ধাক্কা দিয়ে সূর্যে গিয়ে ঠেকার মতাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আর এক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ বিশ্বস্ত বন্ধু হচ্ছে বিজ্ঞান।

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার:

প্রাচীন কালে, বিজ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত মানুষ ছিল প্রকৃতির হাতের এক ক্রীড়নক। গুহাবাসী সেই পশুসদৃশ মানুষ যখন প্রথম পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালায় তখন থেকেই শুরু হয় মানুষের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। তারপর যেখানেই বাধার সম্মুখীন হয়েছে, কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে, মানুষ ব্যবহার করেছে বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেই মানুষ এখন সমগ্র পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। মানব সমাজের যে দিকেই দৃষ্টিপাত করা যায়, শুধু বিজ্ঞানের মহিমাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানের বলে মানুষ জল, স্থল, অন্তরীক্ষ জয় করেছে, মানুষের সংকট নিবারণের ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের বহু অভাবনীয় কৌশল আবিষ্কার করেছে। বিদ্যুৎ, আণবিক শক্তি, কম্পিউটার প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার।

মানবজীবনে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক অবদান:

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মানুষের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিজ্ঞান জড়িত। মানবজীবন আর বিজ্ঞান একই সূত্রে গ্রথিত। যাতায়াত, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ জীবনের হাজারো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। নিচে এর কয়েকটি দিক তুলে ধরা হল :

বিজ্ঞানের প্রভাব বিজ্ঞানের অবদান বা বিজ্ঞানের আশীর্বাদ:

বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ আজ নানাবিধ যন্ত্র আবিষ্কার করে কাজে লাগিয়ে জয় করেছে নিত্যদিনের সুখ, সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যের অনন্য অধিকার। গতনুগতিক অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অলস ও বিশৃঙ্খল মনোবৃত্তির বদলে বিজ্ঞান আজ তাকে করে তুলেছে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণী শক্তিতে তীক্ষণতর, কর্মকুশল, নিয়মনিষ্ঠ, নরলস ও সুশৃঙ্খল। তার গতি আজ অক্লান্ত ও অবাধ, দুর্জয় দুর্বার। তার দৃষ্টির অনন্য আলোয় সে আজ আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে অণু পরমাণু থেকে শুরু করে অসীম ও অনন্ত মহাশক্তি। সেই শক্তিই আজ তাকে দিয়েছে নতুনতর স্বপ্নের স্বর্গরাজ্যে গড়ে তোলার সবচেয়ে সুন্দর ও সার্থক সুযোগ।
মানুষের আরাম-আয়েশ ও সার্বিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্যে বিজ্ঞানের নিত্যনতুন অবদানের আজ তার অন্ত নেই। আলো, পাখা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, ফ্রিজ, হিটার, প্রেসার-কুকার থেকে শুরু করে টিভি, টেপরেকর্ডার, ভিসিআর, সিনেমা, ক্যাসেট প্রভৃতি সাজসরঞ্জাম উন্নততর পোশাক ও প্রসাধনী তাকে আজ সমৃদ্ধি ও সম্ভোগের চরম সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। অন্ধকার থেকে আলোকে আনার সুমহান ব্রতে স্বেচ্ছাদীক্ষিত বিজ্ঞান আজ কাগজ, কলম, কালি ও ছাপাখানার কল্যাণে মানুষের জ্ঞান ও আনন্দ প্রকাশের বিচিত্রতর বাসনাকে বিশ্বের দিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। সক্ষম হয়েছে মহূর্তের মধ্যে পাহাড়-পর্বত কেটে উড়িয়ে নিজের মনমতরূপে তাকে ব্যবহার করতে। সক্ষম হয়েছে মরুভূমিকে সমৃদ্ধ করে আবাদ করার মতো যোগ্যতা অর্জনে। কৃষি ও শিল্প প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বিজ্ঞানের অবদান আজ আর বলে শেষ করা যায় না। মানুষের পৃথিবীকে সরস ও সুন্দর ও স্বর্গস্বরূপ করে গড়ে তুলতে বিজ্ঞানের অবদান তাই তুলনাহীন। সে অর্থে সে আশীর্বাদ ঠিকই।

বিজ্ঞানের অপকারিতা বা বিজ্ঞানের অভিশাপ:

দৈনন্দিন জীবনকে সুখী ও সুন্দরতম করে তুলতে বিচিত্র বিজ্ঞানের অবদানের একদিকে যেমন শেষ নেই, ঠিক তেমনি অন্যদিকে এই বিজ্ঞানই মানুষের জীবনের আশা আনন্দ, সুখ-সমৃদ্ধিকে নস্যাৎ করতেও কিছু কম করে নি। স্বয়ংক্রিয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্র মানুষের কাজ সম্পাদন করতে শুরু করার পরপরই অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। দ্রুত শিল্পায়ন, যন্ত্রশিল্প-কারখানা ইত্যাদি আজ বিশ্বপরিবেশকে ঠেলে দিয়ে ধ্বংসের দিকে। নষ্ট করে দিচ্ছে প্রাকৃতিক ভাসাম্য। বিজ্ঞানের বদৌলতে উদ্ভাবিত মারণাস্ত্রের মহাযজ্ঞ মানুষকে আজ তার অস্তিত্ব সম্পর্কেই সংশয়াকুল করে তুলেছে। রকমারী মারণাস্ত্র, মহাজাগতিক রশ্মির সাহায্যে আরও উন্নততর ধ্বংসাত্মক অস্ত্র উৎপাদন ও পরীক্ষা প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন বিচিত্র যুদ্ধের শক্তিশালী সাজসরঞ্জাম ও মদমত্ত আধিপত্যবাদের হুমকি সুস্থ মানুষের সুখ সমৃদ্ধি নস্যাৎ করে দিচ্ছে। বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান স্বার্থবাদীরা পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোর লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনাহারে অধাহারে অশিক্ষায় ও অত্যাচারে জর্জরিত করে মারছে। সরল সাধারণ মানুষের মন ও পরিবেশকে বিজ্ঞান আজ করে তুলছে জটিল, কুটিল, অতৃপ্ত, সন্দেহপরায়ণ, স্বার্থান্ধ ও যান্ত্রিক। মানুষের ন্যায়-নীতি, শুভবুদ্ধি, সাম্য, স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আজ দলদর্পীদের বিজ্ঞানের সহায়তায় সম্পূর্ণভাবে অস্বীকৃত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ আজ বিজ্ঞানকে ভাবতে শুরু করেছে অনিবার্য অভিশাপ বলে। তাই কবি আহবান করেছেন-

‘মাটি থেকে করব উৎপাট এক সঙ্গে সব চেয়ে লম্বা দেবদারু
যেখানে তার শিকড় ছিল আগে সেই গর্তে ফেলব ছুঁড়ে আমাদের সব অস্ত্র।
ধরিত্রী গর্ভে, ধরনী তলে
পুঁতব মোরা আমাদের সব অস্ত্র, মোরা চিরতরে দেব কবর তাকে সেই গভীরে
আর পুঁতব আবার সেই জায়গায় দেবদারু
হ্যাঁ, আসবে সময় মহা শান্তির।’

উপসংহার:

সূক্ষ্মভাবে বিচার করে দেখলে দেখা যাবে যে, প্রচণ্ড শক্তিশালী বিজ্ঞান নিজে নিজেই আশীর্বাদ বা অভিশাপ কোন কিছুই নয়। আসলে তার মূল সমস্যা হচ্ছে তার ব্যবহারকারীদের সচেতন সঙ্গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে। যে আণবিক বোমা মুহূর্তের মধ্যে নাগাসাকি, হিরোসিমাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে তুলেছিল, সেই আণবিক শক্তির সাহায্যেই আজ রেডিও আইসোটোপের দ্বারা মৃত্যুমুখী মানুষের অশেষ কল্যাণ সাধিত হচ্ছে-দুরারোগ্য ব্যাধির কবল থেকে মানুষ আজ মুক্তি পাচ্ছে। আণবিক শক্তির যথাযথ ও কল্যাণমুখী ব্যবহারে কৃষি, কল-কারখানা বিদ্যুৎ প্রভৃতি বিচিত্রতর ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সম্ভব বলেই বিজ্ঞানীদের আশা। তাই বিজ্ঞানের ব্যবহারের দিকেই বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া দরকার। যে আগুন মানুষের সেবা করে, সে আগুনই আবার মুহূর্তের মধ্যে প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। এর জন্যে দোষ তো আগুণের নয়, দোষ তার ব্যবহারকারীর। ঠিক তেমনি বিজ্ঞানের অসদুদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে কল্যাণের কাজে তাকে ঠিকমতো লাগালে সে সত্যিসত্যিই হয়ে উঠবে আকাঙ্ক্ষিত আশীর্বাদ, অীভশাপ নয়।