রচনা: বাংলার উৎসব

রচনা: বাংলার উৎসব
Admin June 29, 2024 143

ভূমিকা:

মানবজীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হল উৎসব। মানুষ শুধুমাত্র খেয়ে-পরে বেঁচেই সন্তুষ্ট হয় না। সে অনেকের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিতে চায়, দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি চায়।, শ্রমক্লান্ত জীবনে পেতে চায় সহজ অনাবিল আনন্দ। আর সেজন্যই মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে। উৎসব মানুষকে আনন্দ দেয়, প্রসারিত করে তার অস্তিত্বকে। বাঙালি-জীবনে সারাবছর ধরে অজস্র উৎসব লেগে থাকে। বিষয় অনুযায়ী উৎসবগুলিকে মোটামুটি চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-

১. ধর্মীয় উৎসব,
২. সামাজিক-পারিবারিক উৎসব
৩. ঋতু উৎসব এবং
৪. জাতীয় উৎসব।

ধর্মীয় উৎসব:

নানান ধর্মসম্প্রদায়ের বাস এই বাংলায়। সকল সম্প্রদায়ই আপন আপন ধর্মীয় উৎসবে মেতে ওঠে। হিন্দু বাঙালির প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজো। শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে কয়েকদিনের জন্য ধর্মমত নির্বিশেষে বাঙালি-জীবন আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। দুর্গাপূজো ছাড়া কালীপূজো, স্বরস্বতীপূজো, লক্ষ্মীপূজো, বিশ্বকর্মাপূজো, মনসাপূজো, ধর্মপূজো প্রভৃতিও বাংলার বিশিষ্ট ধর্মীয় উৎস। এছাড়া আরও নানা ধরনের ধর্মীয় উৎসব পালিত হয় হিন্দুসমাজে। মহরম, ইদ, সবেবরাত, প্রভৃতি মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসবও বাঙালি-জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। বাঙালি-খ্রিস্টানদের মধ্যেও রয়েছে, বড়োদিন, গুড ফ্রাইডে, ইস্টার স্যাটারডে প্রভৃতি উৎসব।

সামাজিক-পারিবারিক:

মানুষ সামাজিক জীব। ব্যক্তিগত আনন্দ-অনুষ্ঠানকেও সে ভাগ করে নিতে চায় সমাজের আর পাঁচজনের সঙ্গে। এই প্রবণতা থেকেই বাঙালি সমাজে নানা ধরনের সামাজিক উৎসব পালিত হয়ে থাকে। বাংলার সামাজিক উৎসবগুলির মধ্যে বিবাহ, অন্নপ্রাশন, জন্মদিন, উপনয়ন প্রভৃতি বিশেষ উল্লেযোগ্য। এ ছাড়া আরও কিছু উৎসব-অনুষ্ঠান আছে যেগুলি মূলত পারিবারিক। যেমন জামাইষষ্ঠী, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, বিশেষ কোনো ব্রত উদ্‌যাপন প্রভৃতি। তবে এইসব পরিবারকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানগুলিও শেষ পর্যন্ত বাংলার সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। এইসব সামাজিক-পারিবারিক উৎসবের মধ্য দিয়ে আত্মীয়স্বপন, বন্ধুবান্ধব এবং অনাত্মীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গেও একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুদৃঢ় হয় সামাজিক বন্ধন।

ঋতু-উৎসব:

বঙ্গপ্রকৃতিতে ছয়টি ঋতুর আবির্ভাব বাঙালি-জীবনে নিয়ে আসে বৈচিত্র্য। বাংরার মানুষ এই বৈচিত্র্য আরও বেশি করে অনুভব করে বিভিন্ন ঋতুতে অনুষ্ঠিত বর্ণময় উৎসবগুলির মধ্য দিয়ে। বাংলার ঋতু-উৎসবগুলির মধ্রে প্রধান কয়েকটি হল নবান্ন, পৌষপার্বণ, মাঘোৎসব, দোলযাত্রা, নববর্ষোৎসব প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ, বর্ষামঙ্গল, বসন্তোৎসব প্রভৃতি ঋতু-উৎসব বিশেষ গুরুত্ব সহকারে উদ্‌যাপিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ধারা অনুসরণ করে এই সমস্ত উৎসব আজ শান্তিনিকেতনের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

জাতীয় উৎসব:

শুধু ধর্মীয়, সামাজিক পারিবারিক বা ঋতু-উৎসব নয়, বাংলার সমাজজীবনে আর-এক ধরনের উৎসব পালিত হয়, যাকে বলা যেতে পারে জাতীয় উৎসব। স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, নেতাজীজয়ন্তী প্রভৃতি উপলক্ষ্যে প্রতিবছর বিভিন্ন স্থানে যেসব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, সেই অনুষ্ঠানগুলি প্রকৃতপক্ষে উৎসবের চেহারাই ধারণ করে।

উপসংহার:

বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। সেজন্যেই বাঙালি-সমাজে বারো মাসে তেরো পার্বণের সমারোহ। তবে বাংলার উৎসবগুলিকে শুধুমাত্র সাময়িক আনন্দ-উত্তেজনার উৎস মনে করলে ভুল করা হবে। এইসব উৎসব একের সঙ্গে অন্যকে মিলিয়ে দেওয়ার, নিজের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।