রচনা: বাংলাদেশের পুরাকীর্তি : পাহাড়পুর এবং মহাস্থানগড়

রচনা: বাংলাদেশের পুরাকীর্তি : পাহাড়পুর এবং মহাস্থানগড়
Admin June 28, 2024 295

ভূমিকা:

বাংলাদেশ একটি সুপ্রাচীন দেশ। পাচীনত্বের গরিমায় বাংলা সারা বিশ্বে পরিচিত। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি দারুণভাবে উন্নতিলাভ করে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী রাজাদের শাসনামলে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয় এবং ঐ প্রবাহিত ধারা দেশের সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এবং সেই ধারার প্রতি অনুরাগী ও নিষ্ঠাবান করে তোলে। সেন রাজাদের পূর্বে যখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা ধীর্ঘকাল ধরে বাংলা শাসন করেন তখন তাঁদের আমলে ভাস্কর্য ও স্থাপত্যশিল্পের দারুণ উন্নতি হয়। ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার জন্যে ঐ যুগে দূরদেশ থেকে বহু পর্যটক পায়ে হেঁটে বাংলায় আসেন এবং তখনকার দিনের ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেন। চীন দেশের পর্যটক ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাং এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সেই সময় বাংলায় স্বর্ণযুগ বিদ্যমান ছিল।

পাহাড়পুরের পুরাকীর্তি:

বৌদ্ধ যুগে রাজশাহী জেলার পাহড়পুরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের যে আশ্রম নির্মিত হয়েছিল তা কালের প্রবাহে বিলীন হয়ে ধ্বংসস্তূতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ধ্বংসস্তূপ থেকে কিছু কিছু পুরাকীর্তি আবিষ্কার করা হচ্ছে। মাটির সীলমোহরে খোদিত লেখা থেকে চিহ্নিত হয়েছে, সোমপুর বিহারটি পাল রাজা ধর্মপালের আমলে তাঁর অর্থ আনুকূল্যে নির্মিত। হিমালয়ের দক্ষিণে এটাই সবচেয়ে বড় বিহার। এ বিহারটি উত্তর-দক্ষিণে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট। এই চতুষ্কোণ আশ্রমটিতে ১৭৭টি কক্ষ ছিল। এ-সব কক্ষে বৌদ্ধ-ভিক্ষুরা বাস করতেন এবং শাস্ত্র চর্চা করতেন।


পাহাড়পুর আশ্রমটি ছিল ২২ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর বাইরে চারদিক ঘিরে ছিল ১৬ ফুট পুরু একটি দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে ছিল ১৭৭টি কক্ষ। প্রত্যেকটির আয়তন ছিল ১৪′x১৩.৫০′। কক্ষগুলোর সামনে ছিল একটা ৯ ফুট বিস্তৃত বারান্দা।

আশ্রমটির উচ্চতা ছিল ৭২ ফুট এবং এটি তিন স্তরে নির্মিত হয়েছিল। যে দেয়াল দ্বারা আশ্রমটি বেষ্টিত ছিল সে-দেয়ালের উপরে সাজানো ছিল একসারি ৬৩টি পাথরের মূর্তি। এ মূর্তিগুলোতে ব্রাহ্মণ ধর্মের ছাপ সুস্পষ্ট ছিল। মূর্তিগুলোর উপরের দিকে টেরাকোটার চিত্র ছিল। চিত্রগুলোতে ছিল লোকশিল্পের ছাপ। পাথরের ভাস্কর্য মূর্তিগুলোতে যে শুধুমাত্র লোকশিল্পের ছাপ ছিল তা-ই নয়, এগুলোতে ছিল রামায়ণ ও মহাভারতের প্রভাব ও শ্রীকৃষ্ণের জীবনীকেন্দ্রিক চিত্র।


আশ্রম গাত্রে যে-সকল চিত্র অঙ্কিত ছিল তার মধ্যে টেরাকোটা শিল্পের প্রধান্য অধিকমাত্রায় বিদ্যমান। খনন কার্যের মাধ্যমে ২০০০ হাজার টেরাকোটা চিত্রের প্লেট পাওয়া গেছে।

ঐতিহাসিক মূ্ল্যবান এবং স্থাপত্যের উৎকর্ষ বিচারে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের গরিমা অতুলনীয়। এখনকার বৌদ্ধ বিহারের গঠন-সৌষ্ঠবে যে মন্দির-স্থাপত্যের মহিমা পরিব্যাপ্ত তা সারা বিশ্ব পরম বিস্ময়ের সাথে স্বীকার করে। মন্দির স্থাপত্যের এই মহিমান্বিত শৈলী ধীরে ধীরে সুদূর পূর্বদেশে বিস্তারলাভ করে। পাহাড়পুর প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য গরিমার একটি জ্বলন্ত প্রতীক।

উপসংহার:

পাহাড়পুরের মন্দির, পাহাড়পুরের বৌদ্ধ আশ্রম, আশ্রমের কিছুদূরে সত্যপীরের ভিটা, প্লেটের উপর তাম্রলিপি ও ব্রোঞ্জ-নির্মিত মূর্তি এ সব পুরাকীর্তির নিদর্শন পাহাড়পুরের গরিমা বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবী স্বীকার করেছে যে, পাহাড়পুর তথা বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি অতি সুপ্রাচীন যখন বর্তমানের সভ্য দেশগুলোতে সভ্যতার কোনো আলো দেখা দেয় নি।