photo

Nirendranath Chakraborty

Indian poet
Date of Birth : 19 October, 1924
Date of Death : 25 December, 2018 (Aged 94)
Place of Birth : Kolkata, India
Profession : Poet, Writer, Author
Nationality : Indian
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (Nirendranath Chakraborty) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কবি। তিনি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত আধুনিক বাংলা কবিদের অন্যতম। উলঙ্গ রাজা তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থ লেখার জন্য তিনি ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। কবি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সাথে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন।

শৈশব ও কৈশোর

নীরেনের জন্ম ২ কার্তিক ১৩৩১ বঙ্গাব্দে (১৯ অক্টোবর, ১৯২৪) তারিখে ফরিদপুর জেলার চান্দ্রা গ্রামে। শৈশব কেটেছে সেই পূর্ববঙ্গেই, ঠাকুরদা আর ঠাকুমার কাছে। কবির ঠাকুরদা কর্মজীবন কাটিয়েছেন কলকাতায়। কর্মজীবন শেষে ৫০ বছর বয়সে কলকাতার পাট চুকিয়ে বাংলাদেশের ফরিদপুরের বাড়ি চান্দ্রা গ্রামে চলে আসেন। তার বাবা কলকাতাতেই ছিলেন। কলকাতার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি কাজ করতেন। দুই বছর বয়সে কবির মা বাবার কর্মস্থল কলকাতায় চলে যান। কবি থেকে যান তার ঠাকুরদা লোকনাথ চক্রবর্তীর কাছে। গ্রামে কাটিয়েছেন মহা স্বাধীনতায়—ইচ্ছেমতো দৌড়ঝাঁপ করে। কখনো গাছে উঠছেন; কখনো আপন মনে ঘুরেছেন গ্রামের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। চার বছর বয়সে কবির কাকিমা বলেছিলেন, ‌'তুই তো দেখছি কবিদের মতোন কথা বলছিস!' সেই সময়েই মুখস্থ করেছিলেন কবিগান, রামায়ণ গান। গ্রামের দিনগুলো খুব সুন্দর কাটিয়েছেন, তাই তিনি গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় যেতে চাইতেন না।

তাঁর প্রাথমিক লেখাপড়া ফরিদপুরের পাঠশালায়। পরে ঠাকুরদার মৃত্যুর পর গ্রাম ছেড়ে ১৯৩০ সালে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। কলকাতায় এসে প্রথমে কলকাতার বঙ্গবাসী স্কুলে এবং পরে মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে "প্রবেশিকা পরীক্ষা"য় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আই. এ. পাশ করেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট পলস্ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বি. এ. পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় "শ্রীহর্ষ" পত্রিকার সম্পাদনা করে সংবাদপত্রের প্রতি তাঁর নিবিড় ও গভীর অনুরাগের সূত্রপাত হয়।

সাহিত্য জীবন

মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। কিন্তু সেটা কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। ১৬ বছর বয়স থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখে এসেছেন। ১৬ বছর বয়সেই "শ্রীহর্ষ" পত্রিকায় কবিতা লেখার মধ্যে দিয়েই সাহিত্যজগতে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়। "দৈনিক প্রত্যহ" পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। "সত্যযুগ" পত্রিকার সাংবাদিক রূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি একে একে "মাতৃভূমি", "স্বরাজ", "ভারত", "ইউনাইটেড প্রেস অফ্ ইন্ডিয়া" প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করা শুরু করেন। ১৯৫১ সালে যোগ দিয়েছিলেন ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায়। দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। নীরেন্দ্রনাথের প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। এরপর প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নীরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’ সহ অসংখ্য কবিতার বই। সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

তার লেখা ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় সামন্ততান্ত্রিক জমিদার, জোতদার সমাজ ব্যবস্থাকে তীব্র কটাক্ষের বাণে বিদ্ধ করেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবিতার শেষ লাইনে লেখা ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’ লাইনটি আজও মানুষের মুখেমুখে।

কবিসত্তা

তাঁর কবিতার প্রধান আশ্রয় মানুষ। মানুষের প্রেম, ভালােবাসা, আবেগ তাঁর কবিতায় ঠাই পেয়েছে। মানুষের তথা মানবতার অবমাননা তিনি সহ্য করতে পারেননি বলেই সেই অবমাননার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছেন। তিনি সমস্ত ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। তাই সমকালীন জীবনের ভণ্ডামি, শােষণ ও অবিচার তার কলমে ব্যঙ্গের রূপ নিয়েছে। আধুনিক সভ্যতার নেতিবাচক দিক, রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসকের ন্যায়নীতি ভ্রষ্টতা ও প্রজাশােষণ, বুদ্ধিজীবীদের স্তাবকতা ও বিবেকহীনতা প্রভৃতি তাঁর কবিতায় রূপ পেয়েছে। আত্মসর্বস্ব আধুনিক সভ্যতার নির্লজ্জ রুপ দেখে ব্যথিত কবি একটি রূপকের ছলে প্রশ্ন করেছেন শাসক শক্তির কাছে, রাজা তাের কাপড় কোথায়?

কাব্য বৈশিষ্ট্য

মানুষের কবি ও মানবতার পূজারী নীরেন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় মানুষকে দেখেছেন। অখণ্ড দৃষ্টিতে। মানুষের মধ্যেই কবি ঈশ্বরকে দেখেছেন, মানুষের সারল্যের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশকে উপলব্ধি করেছেন। তাই কলকাতার যীশু’ কবিতায় যীশুকে মানবতাবাদের মূর্ত প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন—স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,/টালমাটাল পায়ে/রাস্তার একপার থেকে অন্যপারে হেঁটে চলে যায়। সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।

মানবতাকে উপস্থাপিত করতে গিয়ে কবি জীবনকে ভালােবেসেছেন—গভীর মমত্ববােধ দিয়ে। তাই আশ্রয়হীন পুঁটলি ঘাড়ে করে চলে যাওয়া মানুষটিকে কবি গৃহজীবনে আহ্বান জানান এভাবে-ও বড়াে বউ, ডাকো ওকে ডাকো/এই যে লােকটা পার হয়ে যায়/কাসাই নদীর সাঁকো। তাঁর কবিতা প্রেরণাও মানুষ, তাই মানুষ ও কবিতা তার কাছে সমার্থক। তাই লিখেছেন,—স্পষ্ট কথাটিকে আজ অন্তত একবার খুব স্পষ্ট করে বলে দেওয়া ভাল।/অন্তত একবার আজ বলা ভাল,/যা-কিছু সামনে দেখছি ‘ধোঁয়া বা পাহাড় কিম্বা পরস্পর আলাপ নিরত/ক্ষিপ্র শিশু/হয়তাে তা ছাড়া কোনাে দৃশ্য নেই। সমকাল চেতনা কবির কাব্যে এসেছে বারেবারে। যেমন, চিলের কান্নায় কবি উপলব্ধি করেছেন, অমন ধারালাে শুকনাে বুকফাটা আর্তনাদ আমি/কখনাে শুনিনি।/মনে হয়েছিল, যেন পাখি নয়, বিশ্ব চরাচর/আজ রাত্রে ওই/কলঘরে অন্ধকারে বন্দী হয়ে চিৎকার করছে।

মানুষের কাছে মানুষের জন্য প্রেম ও ভালােবাসা প্রত্যাশা করে লিখেছেন, মানুষ। তােমার প্রেম ছিল।/তবুও, মানুষ, তুমি কিছুই দিলে না/নিখিল সংসারে। কবি যখন সমকালীন জগত দেখে অসহায়তা অনুভব করেন তখন প্রাকৃতিক জগতে খুঁজে পান নির্মল আনন্দ—‘আকাশে গৈরিক আলাে। হেমন্ত-দিনের মৃদু হাওয়া। কৌতুকে আঙুল রাখে ঘরের কপাটে,/জানালায়। পশ্চিমের মাঠে/মানুষের স্নিগ্ধ কণ্ঠ। তিনি মনে করতেন পৃথিবীতে একদিন সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম লুপ্ত হয়ে যাবে এবং মানুষের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে।

মা-মাটি-মানুষকে ভালােবেসে মানুষের প্রতি দৃঢ় আস্থা রেখে কবি উচ্চারণ করেন—“আজকে তুমি কৃপণ বড়,/দিচ্ছ না কিছুই,/তাই যেখানেই বাগান করাে,/ফুটছে না বেল-জুই,/উঠছে না গান তাই বাতাসেব,/আকাশ থমকে আছে,/হাত পেতেছি তাই আমি ফের। মানুষ তােমার কাছে।

পুরস্কার ও সম্মাননা

'উলঙ্গ রাজা’ এই কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৭৪ সালে ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’ পান কবি নীরেন্দ্রনাথ। তা ছাড়াও একগুচ্ছ পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। ১৯৫৮ সালে ‘উল্টোরথ পুরস্কার’, ১৯৭০ সালে ‘তারাশঙ্কর স্মৃতি’ ও ১৯৭৬ সালে ‘আনন্দ শিরোমণি’ পুরস্কার পান কবি। ২০০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি. লিট প্রদান করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছিল।