photo

Mamata Banerjee

Chief Minister of West Bengal
Date of Birth : 05 Jan, 1955
Place of Birth : Kolkata, India
Profession : Politician
Nationality : Indian
Social Profiles :
Facebook
Twitter
Instagram
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম ৫ জানুয়ারি, ১৯৫৫) পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এবং সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা-সভানেত্রী। বর্তমানে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, ভূমি ও ভূমিসংস্কার, তথ্য ও সংস্কৃতি, পর্বতাঞ্চল বিষয়ক, কৃষি, বিদ্যুৎ, কর্মী ও প্রশাসনিক সংস্কার, সংখ্যালঘু কল্যাণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ও মুসলিম জনগোষ্ঠী পালন বিভাগেরও ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন বাগ্মী রাজনীতিবিদ। তাকে প্রায়শই দিদি বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এছাড়াও তাকে অগ্নিকন্যা বলা হয়। ২০১১ সালে তার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এই সরকার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার ছিল। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটে তিনি দুই বার রেল, এক বার কয়লা মন্ত্রকের এবং এক বার মানবসম্পদ উন্নয়ন, যুব, ক্রীড়া, নারী ও শিশুকল্যাণ বিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের জমি বলপূর্বক অধিগ্রহণ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের বিরোধিতা করে আন্দোলন করেছিলেন।

২০১২ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির একজন হিসেবে অভিহিত করেছিল। ব্লুমবার্গ মার্কেটস তাকে ২০১২ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাবশালী ৫০ ব্যক্তির তালিকায় রেখেছিল। ২০১৮ সালে স্কচ বর্ষসেরা মুখ্যমন্ত্রী সম্মাননা লাভ করেন।

জীবনী
প্রারম্ভিক জীবন
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতার হাজরা অঞ্চলে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত সনাতন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাসগৃহে প্রত্যেক বছর শ্রী শ্রী কালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পিতা প্রমীলেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাধীনতা সংগ্রামী কলকাতার শ্রীশিক্ষায়তন কলেজ থেকে বি.এ. ডিগ্রি সম্পূর্ণ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে কলকাতার যোগেশচন্দ্র চৌধুরী আইন কলেজ থেকে এলএল.বি. ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনীতিতে প্রবেশ ছাত্রাবস্থাতেই। শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার পর সংসার চালানোর জন্য কিছুকাল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো বিবাহ করেননি।

জাতীয় কংগ্রেসে রাজনৈতিক জীবন
১৯৭০-এর দশকে অত্যন্ত অল্প বয়সে কংগ্রেস (আই) দলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কর্মজীবনের সূচনা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি স্থানীয় কংগ্রেস নেত্রী রূপে পরিচিত হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কংগ্রেস (আই)-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে সাংসদ নির্বাচিত হন। সেই সময় তিনি ছিলেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ সাংসদের অন্যতম। এই সময় তিনি সারা ভারত যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালের কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়ায় তিনি তার কেন্দ্র থেকে পরাজিত হন। কিন্তু ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র থেকে পুনরায় সাংসদ নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪ ও ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও উক্ত কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৯১ সালে নরসিমা রাও মন্ত্রিসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানব সম্পদ উন্নয়ন, ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিকাশ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী মনোনীত হন। পরে ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে খেলাধূলার প্রতি সরকারি ঔদাসিন্যের প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। ১৯৯৩ সালে তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি তার দলের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-কে সহায়তা করার অভিযোগ আনেন। নিজেকে দলের একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠ বলে উল্লেখ করে তিনি এক "পরিচ্ছন্ন কংগ্রেস"-এর দাবি জানান। কলকাতার আলিপুরে একটি জনসভায় গলায় শাল পেঁচিয়ে আত্মহত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে লোকসভার ওয়েলে বসে পড়েন তিনি। এই সময়ই সমাজবাদী পার্টি সাংসদ অমর সিংহের জামার কলার ধরে তার সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন মমতা। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লোকসভায় রেল বাজেট পেশের দিন পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বঞ্চনার প্রতিবাদে রেল বাজেট পেশ চলাকালীনই তদনীন্তন রেলমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের দিকে নিজের শাল নিক্ষেপ করেন তিনি। পরে তিনি সাংসদ পদ থেকে ইস্তফাও দেন। কিন্তু লোকসভার তদনীন্তন অধ্যক্ষ পি. এ. সাংমা তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাখ্যান করে তাকে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেন। পরে সন্তোষমোহন দেবের মধ্যস্থতায় তিনি ফিরে আসেন।১৯৯৮ সালে সমাজবাদী পার্টির এক সাংসদ সংসদে ‘মহিলা সংরক্ষণ বিল’-এর বিরোধিতা করলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে জামার কলার ধরে লোকসভার ওয়েলের বাইরে বের করে দেন।

১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে মমতা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী একটি মেয়ে ফেলানী বসাককে (যাকে সিপিআই(এম) ক্যাডাররা ধর্ষণ করেছিল বলে অভিযোগ ছিল) রাইটার্স বিল্ডিং-এ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাকে নিগৃহীত করার পরে গ্রেপ্তার এবং আটক করে। তিনি শপথ নিয়েছিলেন যে তিনি কেবল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঐ বিল্ডিংয়ে পুনরায় প্রবেশ করবেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্য যুব কংগ্রেস ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই রাজ্যের কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের উদ্দেশ্যে প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করে। তাদের দাবি ছিল সিপিএমের "বৈজ্ঞানিক কারচুপি" বন্ধ করার জন্য ভোটারদের আইডি কার্ডকে ভোটের জন্য একমাত্র প্রয়োজনীয় দলিল বানানো উচিত। বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশের গুলিতে তেরো জন নিহত হয় এবং আরও অনেকে আহত হয়। এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন "পুলিশ ভাল কাজ করেছে।" ২০১৪ সালের তদন্তের সময়, ওড়িশা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) সুশান্ত চ্যাটার্জি পুলিশের প্রতিক্রিয়াকে "উস্কানিবিহীন এবং অসাংবিধানিক" বলে বর্ণনা করেছিলেন। বিচারপতি চ্যাটার্জি বলেন, "কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ঘটনাটি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের চেয়েও খারাপ।"

তৃণমূল কংগ্রেস
মূল নিবন্ধ: সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস

১৯৯৭ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস স্থাপন করেন। অনতিকাল পরেই তার দল দীর্ঘকাল বামফ্রন্ট-শাসিত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধীশক্তিতে পরিণত হয়। ১৯৯৮ সালের ১১ ডিসেম্বর সমাজবাদী পার্টি সাংসদ দারোগা প্রসাদ সরোজ "মহিলা সংরক্ষণ বিলের" বিরোধিতায় লোকসভার ওয়ালে নেমে গেলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার জামার কলার ধরে টানতে টানতে তাকে ওয়েলের বাইরে বের করে দেন। এই ঘটনায় কিছু বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়।

১৯৯৯ সালে মমতা বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে সামিল হন। এই জোট সরকার গঠন করলে তিনি রেলমন্ত্রী মনোনীত হন।

রেল মন্ত্রকে প্রথম কার্যকাল
২০০০ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার প্রথম রেল বাজেট পেশ করেন। এই বাজেটে তিনি তার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের প্রতি অনেক প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিলেন। দ্বি-সাপ্তাহিক নতুন দিল্লি-শিয়ালদহ রাজধানী এক্সপ্রেস চালুর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসাধনের লক্ষ্যে তিনি চারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুরপাল্লার ট্রেন চালু করেন। এগুলি হল হাওড়া-পুরুলিয়া এক্সপ্রেস, শিয়ালদহ-নিউ জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেস, শালিমার-বাঁকুড়া এক্সপ্রেস ও শিয়ালদহ-অমৃতসর সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস (সাপ্তাহিক)। এছাড়া তিনি পুনে-হাওড়া আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেসের দিনসংখ্যা বৃদ্ধি করেন এবং তিনটি এক্সপ্রেস ট্রেনের পরিষেবার প্রসার ঘটান। তার ক্ষুদ্র মন্ত্রিত্বকালে হাওড়া-দিঘা রেল প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল।

এই সময় তিনি পর্যটন উন্নয়নের দিকেও মনোনিবেশ করেছিলেন। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েতে তিনি দুটি নতুন ইঞ্জিন চালু করেন এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন লিমিটেড প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। এছাড়া ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নির্মাণের ব্যাপারে ভারতের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাংলাদেশ ও নেপাল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়া লাইনগুলি আবার চালু করার কথাও বলেন। ২০০০-২০০১ আর্থিক বছরে তিনি মোট ১৯টি নতুন ট্রেন চালু করেছিলেন।

এনডিএ ত্যাগের পর

"উন্নত মানবিক পৃথিবী", মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক পরিকল্পিত ভাস্কর্য, বকুলবাগান সার্বজনীন, দক্ষিণ কলকাতা, ২০১০।
২০০১ সালের প্রথম দিকে একটি রাজনৈতিক মতবিরোধের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনডিএ-র সঙ্গে সম্পর্ক সাময়িকভাবে ত্যাগ করেন। ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তার দল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। তবে সেবার এই জোট বামফ্রন্টকে পরাজিত করতে অসমর্থ হয়েছিল। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি আবার এনডিএ-তে ফিরে আসেন এবং কয়লা ও খনি মন্ত্রকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তার পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত একমাত্র তৃণমূল সাংসদ।

২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের শিল্পনীতির বিরোধিতা করেন মমতা। ইন্দোনেশিয়া-ভিত্তিক সালিম গোষ্ঠীর মালিক বেনি সান্তোসো পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে এলে সরকার তাকে হাওড়ার একটি কৃষিজমি কারখানা স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রদান করে। এর পরই রাজ্যে বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়। প্রবল বর্ষণের মধ্যেই সান্তোসোর আগমনের প্রতিবাদ জানাতে মমতা ও তার সমর্থকেরা তাজ হোটেলের সামনে জড়ো হন। পুলিশ তাদের হটিয়ে দিলে তারা পরে সান্তোসোর কনভয় ধাওয়াও করেন। উল্লেখ্য, কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি এড়াবার জন্য সরকার সান্তোসোদের কর্মসূচি তিন ঘণ্টা এগিয়ে এনেছিল।

২০০৫ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তীব্র রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েন। এই বছর পৌরনির্বাচনে তার দল কলকাতা পৌরসংস্থার ক্ষমতা হারায়। কলকাতার তদনীন্তন মহানাগরিক সুব্রত মুখোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগ করে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। ২০০৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৭ মার্চ ২০২২ তারিখে বিধানসভা নির্বাচনেও তৃণমূল কংগ্রেস বড়োসড়ো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এই নির্বাচনে পূর্বের বিজিত আসনগুলির অর্ধেকেই দল পরাজিত হয়েছিল।

২০০৬ সালের ৪ আগস্ট লোকসভার তৎকালীন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তার আনা একটি মুলতুবি প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়ার পর মমতা লোকসভার উপাধ্যক্ষ চরণজিৎ সিংহ অটওয়ালের কাছে তার ইস্তফাপত্র পাঠান। পশ্চিমবঙ্গে বেআইনি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে এই মুলতুবি প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপনের সঠিক নিয়মাবলি না মানায় অধ্যক্ষ এটি বাতিল করে দিয়েছিলেন।

২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো প্রকল্পের বিরুদ্ধে একটি জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে তাকে জোর করে বাধা দেওয়া হয়। মমতা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিধানসভাতেই সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে তিনি ১২ ঘণ্টা বাংলা বন্ধও ঘোষণা করেন। তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়করা বিধানসভায় ভাঙচুর চালান, পথ অবরোধ করেন এবং অনেক জায়গায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগও করা হয়। এরপর ২০০৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর একটি বড়োসড়ো ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। সরকার কর্তৃক বলপূর্বক কৃষিজমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে ৪ ডিসেম্বরে মমতা কলকাতায় ঐতিহাসিক ২৬ দিনের অনশন শুরু করেন। তার স্বাস্থ্যের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ. পি. জে. আবদুল কালাম সমস্যাটি সমাধানের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সঙ্গে কথা বলেন। "জীবন মূল্যবান" এই বলে কালাম মমতার কাছে তার অনশন প্রত্যাহারের আবেদন করেন। মনমোহন সিংয়ের একটি চিঠি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর কাছে ফ্যাক্স করা হয় এবং তারপর তা অবিলম্বে মমতার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। চিঠি পাওয়ার পর অবশেষে মমতা ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে তার অনশন ভাঙেন। (মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তার প্রথম কাজগুলির মধ্যে একটি ছিল সিঙ্গুরের কৃষকদের ৪০০ একর জমি ফেরত দেওয়া। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছিল যে সিঙ্গুরে টাটা মোটরস প্ল্যান্টের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার কর্তৃক ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ অবৈধ ছিল।

নন্দীগ্রাম গণহত্যা
মূল নিবন্ধ: নন্দীগ্রাম গণহত্যা
পশ্চিমবঙ্গ সরকার পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে একটি কেমিক্যাল হাব স্থাপন করতে চাইলে তমলুকের সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠের নেতৃত্বাধীন হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ এই অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণের নোটিশ জারি করেন। তৃণমূল কংগ্রেস এর বিরোধিতা করে। মুখ্যমন্ত্রী নোটিশটি বাতিল ঘোষণা করেন। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ কৃষকদের ছয়মাসব্যাপী অবরোধ তুলতে পুলিশ তাদের উপর গুলিচালনা করলে চোদ্দো জনের মৃত্যু ঘটে। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করে। এরপর রাজনৈতিক সংঘর্ষে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। নন্দীগ্রামে তার নিজের দলের কর্মীদের দ্বারা কৃত হিংসাকে সমর্থন করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন "তাদের (বিরোধীদের) একই মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়েছে।" নন্দীগ্রাম গণহত্যার প্রতিবাদে কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একটি বৃহৎ অংশ বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। নন্দীগ্রাম আক্রমণের সময় সিপিআই(এম) ক্যাডাররা ৩০০ জন মহিলা ও মেয়েকে শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ ছিল৷ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও তদনীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাতিলকে লেখা চিঠিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে নন্দীগ্রামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগ আনেন। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নন্দীগ্রামের কেমিক্যাল হাব প্রকল্পটি স্থগিত করতে বাধ্য হন। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে মমতা প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হন। উর্বর কৃষিজমিতে শিল্পের বিরোধিতা ও পরিবেশ রক্ষার যে বার্তা নন্দীগ্রামের আন্দোলন প্রদান করে তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে।

২০০৯ সালের নির্বাচনী সাফল্য
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস অত্যন্ত ভাল ফল করে। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস একাই ১৯টি আসনে জয়লাভ করে। তৃণমূলের জোটসঙ্গী জাতীয় কংগ্রেস ৬টি আসনে ও এসইউসিআই(সি) একটি আসনে জয়লাভ করে। তৃণমূল কংগ্রেস জোট মোট ২৬টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে বামফ্রন্ট ১৫টি ও বিজেপি একটি আসন পায়। তৃণমূল কংগ্রেসের ১৯ জন সাংসদের মধ্যে মহিলা সাংসদের সংখ্যা পাঁচ। উল্লেখ্য, তৃণমূল কংগ্রেস ভারতে মহিলা সংরক্ষণ বিলের প্রবল সমর্থক। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীরা রাজ্যের ৩৩ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের ইতিহাসে প্রথম শাসকদলকে লোকসভা নির্বাচনে পরাজিত করে। এর আগে ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পর রাজ্যের বিরোধী দল সবচেয়ে ভাল ফল করেছিল। কিন্তু সেবারও তাদের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪।

রেল মন্ত্রকে দ্বিতীয় কার্যকাল
হজরত নিজামুদ্দিন-পুনে দুরন্ত এক্সপ্রেস; ট্রেনের গায়ের অলংকরণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিকল্পিত
২০০৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয়বার রেলমন্ত্রী হন। এই বছরের রেল বাজেটে তিনি রেল মন্ত্রকের বিভিন্ন নতুন উদ্যোগের কথা ঘোষণা করেন। দেশের ৫০টি স্টেশনকে তিনি আন্তর্জাতিক সুযোগসুবিধা সম্পন্ন বিশ্বমানের স্টেশনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেন। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে এই উন্নয়নের কাজ করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। এছাড়াও ৩৭৫টি স্টেশনকে তিনি আদর্শ স্টেশন ঘোষণা করেন। গুরুত্বপূর্ণ যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য বাজার, ফুড স্টল ও রেস্তোরাঁ, বইয়ের স্টল, পিসিও/এসটিডি/আইএসডি/ফ্যাক্স বুথ, ওষুধের দোকান ও স্টেশনারি দোকান, স্বল্পব্যয়ের হোটেল এবং ভূগর্ভস্থ পার্কিং ব্যবস্থা সহ মাল্টি-ফাংশনাল কমপ্লেক্স স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই কমপ্লেক্সগুলিও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে গঠিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। রেলের গ্রুপ ডি কর্মচারীদের কন্যাসন্তানদের আত্মস্বনির্ভরতা বৃদ্ধি করতে তাদের উচ্চশিক্ষায় স্কলারশিপ দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলের জমিতে সাতটি নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব দেন। এছাড়া যুব এক্সপ্রেস ও দুরন্ত এক্সপ্রেস নামে দুই প্রকার নতুন ট্রেনও চালু করেন তিনি। দুরন্ত বর্তমানে ভারতের দ্রুততম রেল পরিষেবা।

মহিলা নিত্যযাত্রীদের সুবিধার্থে ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই মমতা হাওড়া-ব্যান্ডেল শাখায় একটি লেডিজ স্পেশাল ট্রেন চালু করেন। পরে শিয়ালদহ-কল্যাণী, পানভেল-মুম্বই সিএসটি ইত্যাদি সারা দেশের একাধিক শাখায় মহিলা স্পেশাল ট্রেন চালু হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর শিয়ালদহ ও নতুন দিল্লির মধ্যে প্রথম দুরন্ত এক্সপ্রেস চালু হয়। ২১ সেপ্টেম্বর চেন্নাই ও নতুন দিল্লির মধ্যে দ্বিতীয় দুরন্ত এক্সপ্রেসটি চালু হয়। মমতা সন্ত্রাসবিধ্বস্ত কাশ্মীরেও রেলপথের প্রসারে মনোযোগী হন। অক্টোবর মাসে অনন্তনাগ-কাদিগন্দ রেলওয়ে চালু হয়। ২০১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মমতা নতুন উনিশটি রেল পরিষেবা চালু করেন।
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয় এবং সরকার গঠন
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে ২২৭টি আসনে (এককভাবে ১৮৪টি আসনে) জয়লাভ করে (মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে) সরকার গঠন করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণ করেন।

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তে, বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ সহ অন্যান্য ইস্যুতে সংঘাত ঘটায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট বা ইউপিএ-এর থেকে সমর্থন তুলে নেন।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সাফল্য
২০১৪ সালে ভারতের লোকসভার নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে লড়ে পশ্চিমবঙ্গের ৩৪টি লোকসভা আসনে জয়লাভ করে।

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে ২১১টি আসনে জয়লাভ করে (মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে) সরকার গঠন করে। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীরূপে পুনরায় শপথ পাঠ করেন। 

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনীর উপর ভিত্তি করে বাঘিনী নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যেটি ২০১৯ সালের মে মাসের ৩ তারিখে মুক্তি পেয়েছে