প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন-১.ট্র্যাজেডি হিসেবে সিরাজউদ্দৌলা নাটকের সার্থকতা বিচার করো।
উত্তর:নায়ককে প্রধান করে কাহিনি এবং করুণ রস পরিবেশনের ফলে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।নায়ক কিংবা নায়িকামুখ্য করুণ রস পরিবেশন ট্র্র্যাজেডির ধর্ম। ট্র্যাজেডি নাটকে কোনো জটিল ও গুরুতর ঘটনার আশ্রয়ে বিশেষ ধরনের রস সঞ্চার করা হয়, যা আমাদের অনুভূতিকে অভূতপূর্ব আবহে আলোড়িত করে, ভয় ও করুণা জাগায়। এ ধরনের নাটকে শত বিপর্যয় সত্ত্বে নায়কের সুদৃঢ় মহিমান্বিত অবস্থান রূপায়িত হয়। ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে আমরা দেখি নায়কমুখ্য কাহিনি এবং কারুণ রসের ব্যঞ্জনা ঘটেছে। সামরিক সামর্থ্য, উচ্চ মর্যাদা, শত্রুর চেয়ে বেশি যোগ্যতা থাকা সত্ত্বে যখন নবাব সিরাজের নির্মম পরাজয় ও মৃত্যু ঘটে, তখন তা সত্যিকার অর্থেই ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন-২.রজার ড্রেক প্রাণভয়ে কুকুরের মতো ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর:সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনা ফোর্ট উইলিয়ামে আক্রমণ করলে গভর্নর রজার ড্রেকের পালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে নবাব প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছেন।
১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ অধিকার করে নেন এবং কলকাতার নামকরণ করেন ‘আলিনগর’। এই দুর্গের যুদ্ধে নবাব সেনার আক্রমণে ইংরেজদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তখন গভর্নর রজার ড্রেক ভয় পেয়ে গোপনে পালিয়ে যান। কিন্তু হলওয়েল প্রকৃত সত্য গোপন করে নবাবকে জানায়, রজার ড্রেক কলকাতার বাইরে গেছেন। রজার ড্রেকের কাপুরুষতার কথা নবাব জানতেন বলেই প্রশ্নোক্ত কথাটি বলে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন।
প্রশ্ন-৩.ভিক্টরি অর ডেথ, ভিক্টরি অর ডেথ- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর:সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে ক্যাপ্টেন ক্লেটন সেনাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘ভিক্টরি অর ডেথ, ভিক্টরি অর ডেথ’-বিষয়টি তার নেতৃত্বগুণ প্রকাশিত হয়েছে।
১৭৫৬ সালের ১৯ জুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে নবাবের বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হচ্ছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাদের কাছে ইংরেজরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছিল। তাদের উৎসাহ দিতে ক্লেটন আলোচ্য কথাটি বলেছিলেন। কারণ তার মতে যুদ্ধে জয়লাভ অথবা মৃত্যুবরণ, এটাই ব্রিটিশ সেনাদের প্রতিজ্ঞা। প্রথমিকভাবে তাকে বেশ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে দেখা গেলেও, শেষে দেখা যায় তিনি তার কথার মতো সাহসী নন।
প্রশ্ন-৪. ওয়ালি খানকে চড় মারার জন্য ক্লেটনের এগিয়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর:সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে ‘বাঙালি কাপুরুষ নয়’-এ কথা বলায় ওয়ালি খানকে চড় মারার জন্য ক্লেটন এগিয়ে যান।ফোর্ট উইলিয়ামে ইংরেজরা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছালে তাদের পক্ষের বাঙালি সেনা ওয়ালি খান ক্যাপ্টেন ক্লেটনকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনারা গোলাগুলি করতে করতে ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের কাছাকাছি এসে গেলে জীবন বাঁচানোর জন্য ওয়ালি খানের বিকল্প কিছু দেখেননি। কিন্তু ক্যাপ্টেন ক্লেটন বাঙালিদের কাপুরুষ বলে গালি দিলে বাঙালি ওয়ালি খান এ কথার প্রতিবাদ করায় ক্লেটন তাকে চড় মারার জন্য এগিয়ে যান। টাকার জন্য বাঙালিরা ইংরেজের পক্ষে গেলেও বাঙালিরা কাপুরুষ ছিল না, এমন প্রতিরোধ ক্লেটন সহ্য করতে পারেননি।
প্রশ্ন-৫.ব্রিটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিলেন, এ বড় লজ্জার কথা- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর:সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলার আক্রমণের মুখে ইংরেজরা পালিয়ে যাওয়ায় প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি করা হয়েছে।
কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে ইংরেজরা নবাবের বিনা অনুমতিতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। তাই নবাব ওই দুর্গ আক্রমণ করেন। ইংরেজ সেনারা নবাবের সেনাদের আক্রমণের মুখে দিশেহারা হয়ে পড়লে ক্যাপ্টেন মিনচিন, কাউন্সিলর ফকল্যান্ড ও ম্যানিংহাম নৌকাযোগে দুর্গ থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। শেষ পর্যায়ে ক্যাপ্টেন ক্লেটনও গভর্নর ড্রেকের সঙ্গে পরামর্শের নাম করে আত্মরক্ষার্থে সব প্রতিজ্ঞা ভুলে দুর্গ থেকে পালিয়ে যান। এমতাবস্থায় বন্দি উমিচাঁদ হলওয়েলকে ব্যঙ্গার্থে প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছিলেন। মুখে বড় বড় কথা বললেও ইংরেজরা শক্ত প্রতিরোধে পালাতে বাধ্য হয়েছিল।
প্রশ্ন-৬.ডাকাত আর ইংরেজরা অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি, কেমন?- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর:সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে ফরাসিরা আর ইংরেজরা অর্থাৎ বিদেশি বেনিয়ারা যে এ দেশে এসেছে মূলত বাণিজ্য করার নামে অবাধলুণ্ঠন করতে, সিরাজউদ্দৌলা সে প্রসঙ্গেই এ কথা বলেছেন।
ইংরেজরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার নিষেধ সত্ত্বে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যায়। ইংরেজদের এই নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে নবাব ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে নেন এবং ওয়াটস ও হলওয়েলকে বন্দি করেন। বন্দিদের কাছে নবাবের নির্দেশ অমান্যের কারণ জানতে চাইলে হলওয়েল জানায়, তারা ফরাসিদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্য দুর্গ নির্মাণ করছিল। হলওয়েলের এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে নবাব কটাক্ষ করে প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করেছেন। ফরাসিরা ডাকাত হলে ইংরেজরাও নিশ্চয় ভালো কিছু নয়- সেটি নবাব ভালোই জানতেন।
প্রশ্ন-৭.তোমার ক্ষমতা ধ্বংস হবে সিরাজ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর:সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের প্রথম অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে হিংসাপরায়ণ হয়ে ঘসেটি বেগম সিরাজউদ্দৌলাকে লক্ষ করে প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করেছিলেন, কারণ নবাব তাকে মতিঝিল প্রাসাদ থেকে গৃহবন্দি করতে সেনাপতি মোহনলালকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সরিয়ে যারা অর্থ ও ক্ষমতা লাভের জন্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ঘসেটি বেগম। সিরাজউদ্দৌলা নবাব হলে তা মেনে নিতে পারেননি ঘসেটি বেগম। তাই তিনি গোপনে মীর জাফর ও অন্যদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ঘসেটি বেগমের এই কর্মকাণ্ড বুঝতে পেরে তাকে মতিঝিল থেকে নবাবের মায়ের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে ক্ষুব্ধ হন ঘসেটি বেগম। আর তখনই তিনি নবাবকে উদ্দেশ্য করে এমন অভিশাপের উক্তিটি করেন।
প্রশ্ন-৮.আমার নালিশ আজ আমার বিরুদ্ধে- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর:সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে প্রজাদের দুর্ভোগের জন্য অন্য কাউকে দোষারোপ না করে আত্মগ্লানি প্রকাশ করতে গিয়ে সিরাজউদ্দৌলা এ কথা বলেছেন, যেখানে মূলত নবাবের অসহায়ত্ব ও দুর্বলতা প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলার নবাব ব্রিটিশ বেনিয়া শক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। তার সাম্রাজ্যের লবণ চাষিরা ইংরেজ কুঠিয়ালদের নির্যাতনের শিকার। নবাব এর প্রতিবিধানে কিছুই করতে পারেননি। তাই প্রকাশ্য দরবারে তিনি সব অমাত্যকে ডেকে জানান নবাব হিসেবে তার অযোগ্যতায় এসব ঘটছে। আসলে তিনি সবাইকে জানালেন বাংলার রাজনীতিতে বিদেশিরা প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং এর পেছনে ইন্ধন জোগাচ্ছেন নবাবের অধিনস্ত লোকেরাই, যাদের প্রধান মীর জাফর আলী খান। তার সামনেই এসব কথা বলে নবাব ক্ষোভ ও বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন।
প্রশ্ন-৯.একটা দিন, মাত্র একটা দিনও যদি ওই মসনদে মাথা উঁচু করে আমি বসতে পারতাম।- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর:সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে মীর জাফরের এ সংলাপে ক্ষমতার প্রতি তার লোলুপ মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে।মীর জাফর সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি। আলীবর্দীর আমল থেকেই তার লোভ ছিল বাংলার মসনদের প্রতি। এ কারণেই সিরাজের শাসনকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। সিরাজের জায়গায় নিজে সিংহাসনে বসার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করেছেন। পবিত্র কোরআনে হাত রেখে শপথ করেও তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তার বাড়িতে ষড়যন্ত্র সভার একপর্যায়ে জগৎশেঠ, রাজবল্লভসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনার সময় প্রশ্নোক্ত বাক্যটি বলে তার সিংহাসনে বসার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন এবং বাস্তবিক অর্থে স্বপ্ন-বিভোর হয়ে ওঠেন।
প্রশ্ন-১০.আপনারা ইচ্ছা করলে আমাদের ক্ষতি করতে পারেন।- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর:সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে ক্লাইভের এ উক্তিতে নবাব সিরাজের অমাত্যবর্গের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটেছে।
মিরনের বাড়িতে ষড়যন্ত্র সভায় ক্লাইভ নারীর ছদ্মবেশে আসেন। জগৎশেঠ ও রাজবল্লভ ক্লাইভের দুঃসাহস দেখে অবাক হন এবং জানান নবাব যদি জানতে পারেন ক্লাইভ এখানে তবে আর উপায় থাকবে না। বিচক্ষণ ক্লাইভ স্পষ্ট জবাব দেন, নবাবের কোনো শক্তি নেই। যার চারপাশে সবাই বেইমান তিনি কী করে ক্লাইভের ক্ষতি করবেন বা শাস্তি দেবেন। বেইমান হিসেবে বরং ওরাই ক্লাইভের ক্ষতি করতে পারেন। বেইমান চিরকাল বেইমান, ক্লাইভ তা জানতেন।