শবে বরাতের ফজিলত

শবে বরাতের ফজিলত
Admin March 07, 2024 30

যে সব মাসে আল্লাহতায়ালা বান্দার জন্য বিশেষ বরকত রেখেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো- পবিত্র শাবান মাস। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রাখতেন।

শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস ও এর ফজিলত

উম্মত জননী হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) রমজান মাস ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ রোজা রাখতে দেখিনি এবং শাবান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে এতো বেশি রোজা রাখতে দেখিনি। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম

অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) বর্ণনা করেন, আমি একদিন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনাকে শাবান মাস ব্যতীত অন্যকোনো মাসে এতো অধিক পরিমাণে রোজা রাখতে দেখিনি। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এটা ওই মাস যে মাস সম্পর্কে অধিকাংশ লোকই গাফেল থাকে। এটা রজব ও রমজান মাসের মধ্যবর্তী মাস। এটা এমন মাস, যে মাসে মানুষের আমলসমূহ আল্লাহতায়ালার দরবারে পেশ করা হয়। আমার আকাঙ্ক্ষা যে, আমার আমল আল্লাহতায়ালার দরবারে এ অবস্থায় পেশ হোক যে, আমি রোজাদার। -নাসায়ি ও শোয়াবুল ঈমান শাবান মাসের ফজিলত সম্পর্কে বিভিন্ন সহিহ হাদিসের কিতাবে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। যার দ্বারা এ মাসের ফজিলত ও গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। সুতরাং এ মাসে রোজা রাখা প্রমাণিত বিষয়। এবার আসি শবে বরাত প্রসঙ্গে। মুমিন মাত্রই এ বিশেষ রাতের নামের সঙ্গে পরিচিত। তবে হাদিস শরিফে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা ‘শাবানের পনেরতম রজনী’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। শবে বরাত শব্দটি ফারসি। শব শব্দের অর্থ রাত আর ‘বরাত’ অর্থ নাজাত, মুক্তি রক্ষা ইত্যাদি। তবে মুফাসসিরে কেরাম এ রাতের আরও কয়েকটি নামের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন লাইলাতুল মোবারাকা, লাইলাতুল বারাআ, লাইলাতুস সাক ইত্যাদি।
-তাফসিরে কুরতুবি এ রাতে যেহেতু গোনাহগারের গোনাহ মাফ হয় এবং অসংখ্য অপরাধীর অপরাধ ক্ষমা করা হয়, সেহেতু এ রাত মুসলমানদের মাঝে ‘শবে বরাত’ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে।পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনে কারিমে নির্দেশনা আছে কিনা এ ব্যাপারে মুফাসসিরে কেরাম মতভেদ করেছেন। আর তাদের এ মতভেদের ভিত্তি হলো- সুরা দুখানের ৩ নম্বর আয়াত এর ভাবার্থ। অধিকাংশ মুফাসসির এ আয়াতের (লাইলাতুল মোবারাকা) শব্দের ব্যাখ্যা ‘শবে কদর’ করেছেন এবং স্বপক্ষে হাদিস পেশ করেছেন। অন্যদিকে হজরত ইকরামা (রা.) এবং কিছু মুফাসসির উক্ত শব্দ দ্বারা ‘শবে বরাত’ বুঝাতে চেয়েছেন এবং স্বপক্ষে হাদিসও পেশ করেছেন উপস্থাপন করেছেন। তাছাড়া পরবর্তীতে অধিকাংশ মুফাসসির যেমন, ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি (রহ.) তার তাফসিরে কাবিরে, ইমাম তাবারি (রহ.) তার তাফসিরে তাবারিতে, আল্লামা জামাখশারি (রহ.) তার তাফসিরে কাশশাফে, আল্লামা আলুসি (রহ.) তার তাফসিরে রুহুল মায়ানিতে, ইবনু কাসির তার তাফসিরে ইবনে কাসিরে, শায়খ ইসমাইল হাক্কি (রহ.) তার তাফসিরে রুহুল বয়ানে, ইমাম কুরতুবি তার তাফসিরে কুরতুবিতে, হজরত আশরাফ আলী থানভি (রহ.) তার তাফসির বায়ানুল কোরআনে, মুফতি শফি (রহ.) তার তাফসিরে মাআরেফুল কোরআনে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় শবে বরাতের আলোচনা করেছেন।

পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনে কারিমে সরাসরি নির্দেশনা না থাকলেও হাদিস শরিফে সুস্পষ্টভাবে এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। এ সব বর্ণনার মধ্যে কিছু বর্ণনা সম্পর্কে পৃথিবীর সব মুহাদ্দিস সহিহ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিছু বর্ণনা হাসান, কিছু দুর্বল বলেছেন। একথা সত্য যে কোনো বিষয়কে প্রমাণের জন্য একটি সহিহ হাদিসই যথেষ্ট।

আর এ বিষয়ে মুহাদ্দিস, ইসলামি স্কলার ও আলেমদের অধিকাংশ একমত যে, ফজিলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিসের ওপর আমল করা জায়েজ এবং ‘জয়িফ’ (দুর্বল) সনদের হাদিস দ্বারাও কোনো আমল মোস্তাহাব হওয়া প্রমাণিত হয়। তাছাড়া হাদিসে শবে বরাত পালন বা ফজিলতের বিপক্ষে কোনো বর্ণনার প্রমাণ নেই।

শবে বরাতের আমল

নফল ইবাদত: নামাজ আদায়, কোরআন তিলাওয়াত, তওবা, ইস্তিগফার ও ক্ষমাপ্রার্থনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে রাত কাটানো। শবে বরাতের সব আমলই নফল। আর নফল আমল নিজ নিজ ঘরে একাগ্রচিত্তে আদায় করাই উত্তম।

রোজা আদায় করা: আলি ইবনে আবি তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন অর্ধ শাবানের রাত তোমাদের সম্মুখে আসে, তখন তোমরা তাতে কিয়াম তথা নামাজ আদায় করো এবং পরবর্তী দিনটিতে রোজা রাখো।’ (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৮)

জিকির ও হাদিস শরীফ পাঠ: শবে বরাতে মুসলিম বৃদ্ধিরা আল্লাহর নাম ও গুণগান, প্রস্তাবনা করার মাধ্যমে হাদিস শরীফ পড়তে এবং ইসলামের আদর্শ আচরণ করতে প্রয়োজনীয় অনুপ্রেরণা প্রাপ্ত করে।

মৃতদের জন্য মাগফিরাত করা: আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি এক রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কাছে না পেয়ে খোঁজ করতে বের হলাম। হঠাৎ দেখলাম, তিনি বাকি কবরস্থানে আছেন। তিনি বললেন, ‘(হে আয়েশা) তোমার কি এ আশঙ্কা হয় যে আল্লাহ ও তার রাসুল তোমার ওপর জুলুম করতে পারেন?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমার ধারণা হলো, আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন।’ তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে আসেন এবং কালব গোত্রের ছাগল-ভেড়ার পশমের চেয়েও অধিকসংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।’ (তিরমিজি: ৭৩৯; ইবনে মাজাহ: ১৩৮৯)

মহিমান্বিত রাত পবিত্র শব-ই-বরাতের ফজিলত, করণীয় ও বর্জনীয়


শবে বরাতের করণীয় :


শবে বরাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতে মুসলিমার জন্য এক বিশেষ উপহার, তাই এ রাতে আমাদের করণীয় ইবাদত সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :


** রাত জেগে ইবাদত করা। যেমন- নফল নামাজ, বেশি বেশি কাজা নামাজ আদায়, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, তওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি। কেননা হাদিসে পাকে এসেছে- এ রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং ফজর পর্যন্ত মানুষকে তাঁর কাছে ক্ষমা, রোগ মুক্তি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি, রিজিক ইত্যাদি বৈধ প্রয়োজনীয় সবকিছু প্রার্থনা করার জন্য আহ্বান করতে থাকেন।


হযরত আবু বকর (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন- আল্লাহ তায়ালা শবে বরাতে পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং কাফের-মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করেন।


হাদিসের ব্যাখ্যায় এসেছে এ ধরনের লোকেরাও যদি খালেছভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ভবিষ্যতে আর কুফরি, শেরেকি ও হিংসা করবে না বলে ওয়াদা করে তবে আল্লাহ এদেরও ক্ষমা করে দেন।


পরদিন রোজা রাখা, কেননা রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- ১৫ শাবানের রাত জেগে ইবাদাত কর এবং পরদিন রোজা রাখ।


*** যতদূর সম্ভব অনাড়ম্বরভাবে কবর জিয়ারত করা। যেমন হাদিসে পাকের ইরশাদ : হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক রাতে রাসূল (সা.) কে হারিয়ে ফেললাম। অতঃপর আমি তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। অবশেষে তাকে জান্নাতুল বাকীতে পেলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, আয়শা তুমি কি আশঙ্কা করছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি জুলুম করবেন? হযরত আয়শা বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল- আমি ধারণা করেছিলাম, আপনি হয়তো আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। অতঃপর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ১৫ শাবান আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বনু-কাল্ব গোত্রের মেষের পশম অপেক্ষা অধিক লোককে ক্ষমা করেন। (তিরমিযী- ১ম খঃ পৃ. ১৫৬) উল্লেখ্য, আরবে বনু কালবের অধিক মেষ ছিল। সুবহানআল্লাহ। 


শবে বরাতে বর্জনীয় :


রাসূল (সা.) স্বীয় জীবন মোবারকে এ রাত বারবার পেয়েছেন, আমল করেছেন। এ রাতে কি করতে হবে, কি ভাবে করতে হবে তা বলে এবং সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে আমাদের শিখিয়ে গেছেন। তারপর সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং যুগে যুগে ওলামা ও মাশাইখে কিরাম এ রাতে ইবাদাত করে গেছেন। তাদের রেখে যাওয়া আদর্শই হুবহু আমাদের অনুসরণ/অনুকরণ করতে হবে। নিজের পক্ষ থেকে বাড়ানো-কমানোর কোনই অবকাশ নেই। আমাদের দেশে শব-ই-বরাতে প্রচলিত কিছু বর্জনীয় কার্যকলাপ নিম্নে পেশ করা হলো।


** অনেকেই এ রাতে মহা ধুম-ধামে হালুয়া রুটির ব্যবস্থা করেন, যার সাথে শবে বরাতের নূন্যতম কোন সম্পর্ক নেই। কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের কোন ভিত্তি নেই। বরং এ পবিত্র রাতে হালুয়া রুটি ইবাদাতে বিঘ্ন ঘটায়। এর পেছনে পরে মানুষ বঞ্চিত হয় আল্লাহ প্রদত্ত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত থেকে। কাজেই অন্তত এ রাতে এটা বর্জনীয় (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া)।


*** অনেকেই এ রাতে আতশবাজি, আলোকসজ্জা, শোরগোল ও হৈ চৈ করে থাকেন যা চরম বিদআত কুসংস্কার, গুণাহের কাজ ও হারাম। এ রাত তো কোন আনন্দ উৎসবের রজনী নয়। অধিকন্তু এটা অপচয়ও বটে। ইসলামে অপচয় করা কবিরা গুণাহ, মহাপাপ। পবিত্র কোরআনে পাকে আল্লাহ পাকের ঘোষণা তোমরা অপচয় কর না নিশ্চয় অপচয়কারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না। (সূরা আ’রাফ আয়াত. ৩১) পবিত্র কোরআন পাকে অন্য স্থানে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। নিশ্চই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই (বনী ইসরাইল – ২৭)।


আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের যথাযথভাবে শব-ই-বরাত পালন করার তৌফিক দান করুক। আমীন