রচনা: যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই

রচনা: যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই
Admin July 16, 2024 107

ভূমিকা:

‘তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে,
দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে।
– সুকান্ত ভট্টাচার্য।
মানুষ সহজাতভাবে শান্তিপ্রিয় ও শান্তিকামী। কিন্তু সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। মানব সভ্যতার এই প্রত্যূষ মুহূর্ত থেকেই যুদ্ধ, সংঘর্ষ বিকাশ? প্রতিটি শস্যের শীর্ষে মানুষের রক্ত খুঁজে পাবে।’ অনেক রক্ত ঝরেছে। সভ্যতার বেদীতল যুগে যুগে শোণিত স্রোতে হয়েছে রঞ্জিত। আজও মানুষ ভুলতে পারে নি সেই রক্তাক্ত দিনের ভয়ঙ্কর স্মৃতি। আজকের যুদ্ধের নির্মম অর্থ মানুষ জেনে গেছে, যুদ্ধ নিয়ে আর দম্ভ নয়, নয় প্রভুত্ব বিস্তারের বিলাসিতা। যুদ্ধ মানে আজ সভ্যতার বিনাশ। যুদ্ধ মানে এখন মানুষের অস্তিত্ব বিলোপ। তাই বিশ্বের দিকে দিকে আজ যুদ্ধ-বিরোধী জেহাদ। আর তাই শান্তিকামী মানুষ শান্তি রক্ষার প্রত্যাশায় শান্তির বাণী উচ্চারণ করে প্রতিষ্ঠা করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘও আজ পক্ষপাত দুষ্টে আক্রান্ত। গোটা বিশ্ব জুড়ে স্লোগান তুলেছে : যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে গেয়ে উঠেছে : 

আর যুদ্ধ নয়, নয়। 
আর নয় মায়েদের শিশুদের কান্না 
রক্ত কি, ধ্বংস কি, যুদ্ধ- আর না, আর না। 

অতীতে যুদ্ধ:

যুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায় বিগত সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পৃথিবীর বুকে মোট যুদ্ধ হয়েছে সাড়ে চৌদ্দ হাজার, প্রাণ হারিয়েছে চারশ কোটি মানুষ। একদিন যুদ্ধকে মনে করা হতো শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। রাজ্যজয়ের নেশায় মেতেছে মানুষ বীরের সম্মানে ভূষিত হয়ে জীবন ধন্য হয়েছে কত মানুষের। ইতিহাসের কলঙ্কিত নায়ক হয়ে আজও বিভীষিকার দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে কত মানুষ। আমরা এট্টিলা, চেঙ্গিস খাঁ, তৈমুর লঙ-এর শোণিত-বিলাসের কথা আজও ভুলি নি। ভুলি নি আলেকজান্ডার পুরু, হানিবলের বীরত্ব গাথা। কত ধর্মযুদ্ধ, কত সাম্রাজ্যের উত্থান আর পাতন। পথে পথে কত রক্ত-স্রোত বয়ে গেছে। কত অশ্ব ক্ষুরধ্বনি। কত অসির ঝনঝনা, হস্তীর বৃংহন,অশ্বের হ্রেষা। 

বিগত বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা:

জীবন চলমান। সভ্যতা থেমে থাকে না। মানুষ বিজ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে খুঁজে পেল আরও অজ্ঞতা শক্তির উৎস। ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠল আরও শক্তিধর। বানাল নতুন নতুন অস্ত্র। বিগত শতকে ঘটল দুই ভয়াবহ মহাযুদ্ধ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯ ও ১৯৩৯-৪৫)। এ যুদ্ধ অতীতের সব যুদ্ধকে ছাপিয়ে গেল। কারণ এর বিস্তৃতি ঘটেছিল বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক মারণ-যজ্ঞে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল বোমারু বিমান ও আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত যুদ্ধ জাহাজ। নিহত হয়েছিল সামরিক ও সামরিক স্তরের চার কোটি চৌদ্দ লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষ। বিকলাঙ্গ হয়েছিল আরও দুই কোটি মানুষ। সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছিল তিনশ কুড়ি বিলিয়ন ডলারের। (১ বিলিয়ন = ১০,০০০ লক্ষ = ১০০ কোটি)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিহত মানুষের সংখ্যা সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এই যুদ্ধ পাঁচ কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ সংহার করে। বিকলাঙ্গ করে ন’ কোটি মানুষকে। সম্পত্তি বিনষ্ট করে চারশ বিলিয়ন ডলারের। এই মহাযুদ্ধেই মানব-সভ্যতার ঘৃণ্যতম অস্ত্র আণবিক বোমা ব্যবহৃত হয় জাপানে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। চোখের পলকে দাউ দাউ আগুনে জ্বলে যায় দুটি সমৃদ্ধ জনপদ। তেজস্ক্রিয় বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে শহরে-গ্রামে। ধ্বংসের প্রলয়ঙ্কর রূপ দেখে শিহরিত হয় বিশ্ববিবেক। আর্তনাদ করে ওঠে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ। 

বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও বিশ্বপরিস্থিতির লক্ষণীয় পরিবর্তন:

উপনিবেশ বিস্তারের লোলুপতা, বিশ্বের বাজার দখলের প্রতিযোগিতা এসবই ডেকে আনে বিশ্বযুদ্ধ। সমরাস্ত্র উৎপাদনের নেশায় তখন মেতে ওঠে যুদ্ধবাজের দল। সমরোপকরণের বাজার অব্যাহত রাখার প্রয়োজনেই যুদ্ধের সর্বগ্রাসী আগুন কখনও নেভে না। 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে অনেক ছোট হয়ে গেছে আজকের পৃথিবী। আজ যদি পেছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখব বিংশ শতাব্দীতে কত অকল্পনীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে বিশ্বে। সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য কতবারই না এদিক-সেদিক পরিবর্তিত হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যস্ত না হবার যে সদম্ভ ঘোষণা লর্ড কার্জন করেছিলেন তা আজ শতাব্দী না পেরোতেই হাস্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বলশেভিক বিপ্লবের দুনিয়া কাঁপানো আওয়াজ একদিন সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল মুক্তির সংগ্রাম। অমিত ক্ষমতার অধিকারী সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনে সে সংগ্রামকে হীনবল করে দিয়েছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একক ক্ষমতাধর শক্তিতে পরিণত হয়েছে, ছাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা এক বিশ্বকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। অন্যদিকে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, অতি উন্নত ইন্টারনেট ও দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম পৃথিবীকে পরিণত করেছে এক বৈশ্বিক গ্রামে। অথচ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার কোটি কোটি মানুষ প্রাযুক্তিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও ব্যাধি এদের নিত্যসঙ্গী। একদিকে সম্পদের পাহাড়, অঢেল ঐশ্বর্য, অকল্পনীয় বিলাস বৈভব, অন্যদিকে এক ‘জলহীন ফলহীন আতঙ্ক পাণ্ডুর মরুক্ষেত্রে পরাকীর্ণ পশু কঙ্কালের মাঝে মরীচিকার প্রেতনৃত্য’ চলছে- এই বিপরীতধর্মী অসুন্দর অসভ্যতা বর্তমান বিশ্বের এক নিয়ামক চিত্র। 

আধুনিক সমরাস্ত্রের ভয়াবহতা:

পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা আজ এক উদ্বেগজনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, সামরিক খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ছে। অস্ত্রনির্মাণে ঢালাওভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। মানব সমাজ আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় থর থর কম্পমান। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর হাতে এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র মজুত আছে। সংরক্ষিত আছে সমগ্র দ্বিতীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত বিষ্ফোরকের দশ হাজার গুণ এবং প্রতি মানুষ পিছু পনের টনেরও বেশি বিষ্ফোরক। আণবিক বোমার চেয়ে চার হাজার গুণ শক্তিশালী বোমার সংখ্যা এখন পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার। যুদ্ধ এখন শুধু জলে-স্থলে নয়, মহাকাশে গ্রহে-উপগ্রহে বিস্তৃত হবার সম্ভাবনা। এখন দূরপাল্লার রকেট, আণবিক যুদ্ধ জাহাজ, সাবমেরিন ইত্যাদি সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র মানুষের করায়ত্ব। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য বিশ্বের দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছে উদ্বেগের। নক্ষত্র যুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে মার্কিন মুলুকে। লেসার রশ্মির সাহায্যে প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র মহাশূন্যে ধ্বংস করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে মার্কিন সমর বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের ফলে বিশ্ব শক্তির ভারসাম্যের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তাতে অনুন্নত জাতিসমূহকে আজ অসহায়ভাবে মার্কিন অবরোধ ও সামরিক হুমকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। লিবিয়া, ইরাক, কিউবা, উত্তর কোরিয়াসহ গোটা তৃতীয় বিশ্ব ও ইসলামিক বিশ্ব আজ সে হুমকির শিকার। সদ্য ২০০৩ সালে আমেরিকা অযাচিত ও অন্যায়ভাবে ইরাকের তেলসম্পদ লুণ্ঠনের জন্যে আক্রমণ করল ইরাক, তাদের বর্বর আক্রমণে লক্ষ লক্ষ ইরাকি নারী-পুরুষ মৃত্যুবরণ করেছে, হয়েছে বিকলাঙ্গ। যেখানে গোটা বিশ্বে নানারকম আঞ্চলিক পর্যায়ে সংঘাত, যুদ্ধ, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, রোগভোগ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষ, সেখানে সভ্যতা আজ নীরব প্রত্যক্ষ করছে মার্কিনীদের তাণ্ডব। 

যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বখ্যাত কবি সাহিত্যিক শিল্পী বিজ্ঞানী ও বিভিন্ন সংস্থার জেহাদ:

তাই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আজ আর যুদ্ধ চায় না। তাই পিকাসোর শ্বেত শুভ্র পারাবর আজ দেশে দেশে হাজারে হাজারে নীল গগনে ডানা মেলে উড়ছে। দেশে দেশে যুদ্ধ-বিরোধী শান্তি-মিছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলেই এই শান্তির দাবি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। গঠিত হয়েছিল ‘যুদ্ধ ও ফ্যাসিবিরোধী সংঘ’। অনুষ্ঠিত হয়েছে জেনেভা সম্মেলন। আইনস্টাইন, রমা, রলাঁ, আঁরি বারবুস, ম্যাক্সিম গোর্কি, রবীন্দ্রনাথ সোচ্চার হয়েছিলেন নারীঘাতী, শিশুঘাতী কুৎসিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে। বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন ফ্যাসিস্ট বর্বরতার। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে আজ শান্তি আন্দোলন শান্তিশালী হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গড়ে উঠছে নানা সংঘ, নানা কমিটি। 

জাতিসংঘ ও বিশ্ব শান্তি আন্দোলন:

১৯৪৫ সালের আগস্টে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসান ঘটলেও এই নতুন অস্ত্রের ভয়াবহ ক্ষমতা দেখে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। শান্তিকামী মানুষের উদ্যোগে গঠিত হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা জাতিসংঘ। কিন্তু আজ দুঃখ ও লজ্জাজনক যে জাতিসংঘ পরিণত হয়েছে ‘পুতুলসংঘে’ – অকার্যকর এক সংঘে। আমেরিকা জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে আক্রমণ করেছে ইরাক। হত্যা করছে ইরাকের লক্ষ-কোটি শান্তিকামী মানুষকে। আজ দিকে দিকে পুনরায় স্লোগান ওঠেছে- ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ – কিন্তু এই শান্তি কীভাবে আসবে বিশ্ববাসীর আজ তা জানা আছে বলে মনে হয় না। আজ মানুষ ভয়াবহ এক সঙ্কটের মধ্যে বসবাস করছে। 

উপসংহার:

যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। যুদ্ধ মানেই দুর্ভিক্ষ, উপবাস, মৃত্যু, তিলে তিলে গড়ে তোলা সভ্যতার সম্পূর্ণ ধ্বংস। তাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ আজ প্রতিরোধী সৈনিক, শান্তির জাগ্রত প্রহরী। অতীতের মতোই আজ বিশ্বব্যাপী শান্তির আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। সারা বিশ্বে যদি কোটি কোটি মানুষ আজ অস্তিত্বের তাগিদে শান্তির সপক্ষে রাস্তায় নেমে আসে তাহলেই শুধু যুদ্ধবাজ বর্বরজাতির দংশন থেকে এই বিশ্বকে রক্ষা করা সম্ভব। আজ সারা বিশ্বের অস্ত্রবাজদের এই শপথ নিতে হবে যে- 

‘মাটি থেকে করব উৎপাট এক সঙ্গে সব চেয়ে লম্বা দেবদারু 
যেখানে তার শিকড় ছিল আগে সেই গর্তে ফেলব ছুঁড়ে আমাদের সব অস্ত্র। 
ধরিত্রী গর্ভে, ধরণী তলে পুঁতব মোরা আমাদের সব অস্ত্র, 
মোরা চিরতরে দেব কবর তাকে সেই গভীরে 
আর পুঁতব আবার সেই জায়গায় দেবদারু 
হ্যাঁ, আসবে সময় মহা শান্তির।’