রচনা: কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা

রচনা: কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা
Admin July 05, 2024 103

ভূমিকা:

শিক্ষা মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটায়। জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে তাকে সামর্থ্য ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার ও সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ফলে মানব জীবনের নিত্যনতুন কর্মদিগন্ত খুলে গেছে। ফলে বংশানুক্রমিক পেশাগত বৃত্তি অবলম্বন করে নিশ্চিত জীবনযাপনের দিন ফুরিয়ে গেছে। বরং নিত্যনতুন যে কর্মদিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে তার সঙ্গে বিশেষায়িত শিক্ষার যোগ হয়ে পড়েছে অপরিহার্য। এই কারণে আধুনিক বিশ্বে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষা ক্রমের অধিকতর গুরুত্ব লাভ করছে।

সংজ্ঞা ও গুরুত্ব:

কর্মমুখী শিক্ষা হচ্ছে জীবিকা অর্জনের জন্যে সম্ভাব্য পেশাগত কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা। মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ও বৈশিষ্ট্যের ব্যাপক পরিবর্তন এবং জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার ফলে কর্মমূখী শিক্ষার গুরুত্ব ও চাহিদা বাড়ছে। এককালে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে বাস করে বাংলাদেশের মানুষ সুখে জীবন কাটিয়েছে। বৃত্তি বা পেশাগত শিক্ষা নিয়ে তাকে ভাবতে হয় নি। বংশানুক্রমিক পেশা অবলম্বন করেই জীবিকা নির্বাহ করেছে। কিন্তু এখন সে দিন আর নেই। জনসংখ্যা এখন বেড়েছে বিপুলভাবে। তার প্রচন্ড চাপ পড়েছে সীমিত সম্পদের ওপর। ফলে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশে নব নব কর্মসংস্থান ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর না হলে জাতীয় জীবনে নেমে আসবে অনিবার্য সংকট।

আর তার জন্যে দরকার নিত্যনতুন কর্ম, বৃত্তি ও পেশার সঙ্গে জড়িত কর্মমুখী শিক্ষা। কিন্তু দুঃখের বিষয় দেশে এখনও সেই ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে কেরানি তৈরির উপযোগী সাধারণ শিক্ষার প্রাধান্যই রয়ে গেছে। ফলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়ে যারা বের হচ্ছে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় তাদের ব্যাপক অংশেই বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রচন্ড হতাশায় জীবনের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। এই কারণে যতই দিন যাচ্ছে কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব সবাই উপলব্ধি করছে। বিশ শতকের শেষ দশকে আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করা গেছে। এটা এখন স্পষ্ট যে, বর্তমান বাস্তবতায় কর্মমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তা দেশের অগ্রগতি সাধনে যেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তেমনি দেশে এবং দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব মোচনেও ফলপ্রসূ অবদান রাখতে সক্ষম। এতে বহু পরিবার অশান্তির হাত থেকে বাঁচতে পারে। এই শিক্ষার প্রসার ঘটলে সাধারণ ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অনভিপ্রেত ভিড় হ্রাস পাবে। তাছাড়া কর্মমুখী শিক্ষা স্বকর্ম সংস্থানের নানা সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং তা ফলত দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ও দারিদ্র্য দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কর্মমুখী শিক্ষা কেবল নতুন নতুন কর্মস্থানের সুযোগ তৈরি করে না, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের নানা ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে। সেদিক থেকে কর্মমুখী শিক্ষা জাতির অর্থনৈতিক বুনিয়াদ রচনায়ও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারে। কর্মমুখী শিক্ষা স্বাধীন পেশা গ্রহণে ব্যক্তির আস্থা গড়ে তোলে, তাকে স্বাবলম্বী করে তোলে এবং এভাবে বিপুল সংখ্যক বেকারত্বের হাত থেকে জাতিকে বাঁচায় এবং পরমুখাপেক্ষী অবস্থায় অভিশাপ থেকে রক্ষা করে। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির যুগে কর্মমুখী শিক্ষা তাই আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

কর্মমুখী শিক্ষার স্বরূপ:

কর্মমুখী শিক্ষা যান্ত্রিক শিক্ষা নয়। জীবনমুখী শিক্ষার পরিমন্ডলেই তার অবস্থান। পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক জীবনবোধের আলোয় বিচার করা হয় কর্মমুখী শিক্ষার ভূমিকাকে। কর্মমুখী শিক্ষা নিঃসন্দেহে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক জনশক্তি সৃষ্টি করতে চায় কিন্তু তার মানবিক গুণাবলির বিকাশের দিকটিও উপেক্ষিত থাকতে পারে না। এদিক থেকে কর্মমুখী শিক্ষার লক্ষ ত্রিমুখী:

ক. জ্ঞান জিজ্ঞাসা সৃষ্টিতে : জ্ঞান-বিজ্ঞানের অর্জনের সঙ্গে শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটানো, অজানাকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি এবং সুপ্ত গুণাবলির বিকাশ ঘটানো।

খ. মূল্যবোধ সৃষ্টি : শিক্ষার্থীকে নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং মানবিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করা এবং গণতন্ত্রমনা, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক হিসেবে তাকে গড়ে তোলা।

গ. কাজে উৎসাহ সৃষ্টি : কর্মমুখী, জীবনসম্পৃক্ত, বৃত্তিমূলক, উপার্জন মনষ্ক জনশক্তি গড়ে তোলা।

এই গুরুত্বপূর্ণ তিনটি লক্ষ অর্জন করতে পারলে বাড়তি জনশক্তি হবে জনসম্পদ আর তা না হলে, আংশিক কর্মমুখী শিক্ষা মানুষকে তৈরি করবে মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জিত নিছক যন্ত্রে।

কর্মমুখী শিক্ষার বিদ্যমান সুযোগ:

আমাদের দেশে এখনও কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে নি। ফলে প্রচলিত পন্থায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে লাখ লাখ উচ্চ শিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকারত্বের চরম অভিশাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও হতাশায় নিমর্জিত। অথচ উন্নত দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাভিক্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এমনকি এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাই্যোন্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে কর্মমুখী শিক্ষা যথেষ্ট গরুদুত্ব পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত। আর বাংলাদেশে এ হার ১ শতাংশেরও কম। এর কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অনভিপ্রেত উপেক্ষা। এমনকি সাম্প্রতিককালে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অনেক কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীতকরণের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতেও কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি যথেষ্ট উপেক্ষিত হয়েছে। এর ফলে অনিবার্যভাবে শিক্ষিত বেকারের সংক্যা আও বাড়ছে। অথচ যদি বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করা হতো তবে অনেক তরুণ জীবন-জীবিকার নিশ্চিত অবলম্বনকে আশ্রয় করে সুখ-শান্তিময় ভবিষ্যৎ রচনা করতে সক্ষম হতো।

কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারের প্রচেষ্টা:

বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র যে একেবারে উন্নয়ন হয় নি তা নয়। বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষার কার্যক্রম ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে বিভাগ ও জেলা ভেদে প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ২২টি মেডিকেল কলেজ ও ১টি ডেন্টাল কলেজের মাধ্যমে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়েছে। এছাড়াও ৪টি প্রকৌশল ইনস্টিটিউট, অনেকগুলো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও ভেকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, লেদার টেকনোলজি কলেজ, টেক্সটাইল টেকনোলজি কলেজ, গ্রাফিক আর্ট ইনস্টিটিউট ইত্যাদির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত ছোটখাটো কারিগরি প্রতিষ্ঠান দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে। তবে সব মিলিয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষার যে সুযোগ এখন বিদ্যমান তা যে বিপুল জনসংখ্যার তুলায় একেবারে নগণ্য তা বলাই বহুল্য।
তবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য সাম্প্রতিককালে সরকার মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরেই কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই কার্যক্রমকে বেগবান করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কারণ, মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে দেশের শিক্ষিত জনশক্তি। ইতমধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো : কৃষিবিজ্ঞান ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞানকে বাধ্যতামূলক করণ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডাবল শিফট চালু, স্কুল ও মাদ্রাসায় নবম ও দশম শ্রেণিতে বেসিক ট্রেড কোর্স চালু, ১৯৯৫ সাল থেকে সাধারণ শিক্ষা ও ভোকেশনাল শিক্ষা সমন্বয়ে এস. এস. সি. শিক্ষাব্যস্থা চালু, মাধ্যমিক স্তরে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা শিক্ষাব্যবস্থা চালু ইত্যাদি।

কর্মমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তমায়নের সমস্যা ও সুপারিশ:

কর্মমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষক, অন্যান্য লোকবল, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, আর্থিক ব্যয় সংকুলানের ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও প্রকট সমস্যা বিদ্যমান। শিক্ষকদের গুণগত মান উন্নয়নের জন্যে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। এসব সমস্যা মোকাবেলার জন্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা প্রয়োজন:

১. কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু ও প্রসার করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ও মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা।

২. বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার জন্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ।

৩. কর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের ভোকেশনাল শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং

৪. বৃত্তিমূলক শিক্ষা, কারিগরি এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষা কার্যক্রমে উৎসাহ তৈরির জন্যে জাতীয় প্রচার মাধ্যমে সৃজনশীল কার্যক্রম প্রচার।

উপসংহার:

আমাদের দেশ বাড়তে থাকা বেকার সমস্যাসহ সামাজিক কুসংস্কার, জনসংখ্যা সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত। এই প্রকট সমস্যা কাটিয়ে ওঠার অন্যতম প্রচেষ্টা হিসেবে তরুন সমাজকে উপযুক্ত গঠনমূলক ও কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান অত্যন্ত কার্যকরী হবে। এ কাজে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি এবং তা বাস্তমায়নের জন্যে দরকার উপযুক্ত বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল। তাহলেই এ মহৎ প্রয়াস জাতীয় জীবনে ইতবাচক ফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে।