রচনা: দেশ ও জাতি গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা

রচনা: দেশ ও জাতি গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা
Admin July 04, 2024 481

ভূমিকা :

বিদ্যালয়–মহাবিদ্যালয়–বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সময়কালকেই সাধারণত ছাত্রজীবন বলা হয়। জীবনের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য এ সময়টাই সর্বোৎকৃষ্ট সময়। ভিত্তি সুদৃঢ় না হলে যেমন ইমারত ও দীর্ঘস্থায়ী হয় না, তেমনি ছাত্রজীবন বৃথায় নষ্ট করলে ভবিষ্যৎ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। ছাত্রসমাজ দুর্বার প্রাণশক্তির প্রতীক। তাদের মধ্যে নিহিত আছে শক্তির প্রাচুর্য, সম্ভাবনার সীমাহীন রাজ্য। তারাই জীর্ণতার অন্ধকারে ছিন্নভিন্ন করে আনে আলোকোজ্জ্বল নতুন প্রভাত।

ছাত্রজীবনের স্বরূপ :

ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। আজকের ছাত্ররাই ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। তই জীবনগঠনে ছাত্রজীবন অত্যন্ত মূল্যবান। জ্ঞান–বিজ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হয় এই ছাত্রজীবনেই। মানবজীবনের সার্থক বিকাশের জন্যে মনুষ্যত্বের যে সাধনা তা ছাত্রজীবনে রূপ লাভ করে। তাদের সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত হয়। বিকশিত মেধা জীবনের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। নিরলস সাধনায় জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করে তারা নিজেদের সমৃদ্ধ করে ছাত্রজীবনেই। তাই ছাত্রজীবন প্রস্তুতির জীবন। এরই ওপর নির্ভর করে তার পরবর্তী জীবনের সফলতা–ব্যর্থতা। নির্ভর করে তার ভবিষ্যৎ জীবনের গতি–প্রকৃতি। ছাত্রজীবন ভবিষ্যতের পল্লবিত সৌন্দর্যের অস্ফুট পটভূমি। 

ছাত্রদের কর্তব্য :

ছাত্রজীবন কর্মজীবনে প্রবেশের প্রস্তুতি–পর্ব। জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগই একজন ছাত্রের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। 
ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ
সতুরাং অধ্যয়নই ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা হওয়া উচিত। অধ্যয়নের সাথে সাথে তাকে মানব-চরিত্রের নানাবিধ সৎ গুণাবলিও অর্জন করতে হবে। যেমন : মাতা-পিতা-শিক্ষক-গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সময়ের সদ্ব্যবহার ইত্যাদি। সঙ্গদোষে মানুষের চরিত্র মন্দ হয়ে থাকে তাই কুসঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। পার্থিব চাকচিক্য ও ভোগবিলাস উপেক্ষা ও বর্জন করে ছাত্রজীবনে শুধু জ্ঞানসাধনায় লিপ্ত থাকাই সর্বোৎকৃষ্ট। আত্মা বা মানসিক উৎকর্যসাধন জীবনের মূল লক্ষ্য। শুধু পুঁথিগতবিদ্যা অর্জনে সার্বিক জ্ঞানলাভ হয় না। বহির্জগতের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে বিবিধ জ্ঞান আহরণ করতে হবে। বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, অর্থনীতি, পৌরনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি, দর্শনশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। পতিপয় নির্ধারিত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পরীক্ষায় শুধু পরীক্ষায় পাস করাটাই বড় কথা নয়। প্রকৃত জ্ঞান লাভের জন্যে ভালো করে চিন্তা ও মননশক্তির বিকাশের জন্য বিবিধ শাস্ত্রে অনুশীলন একান্ত কর্তব্য। পরীক্ষা নিছক উপলক্ষ, প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন। সাম্প্রতিককালে শিক্ষাঙ্গনে যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে তা থেকে নিজেদের সাবধানে দূরে সরিয়ে রাখা ছাত্রদের কর্তব্য বলে বিবেচনা করতে হবে। 

ছাত্রদের দায়িত্ব :

ছাত্রসমাজের দায়িত্ব শুধু পড়াশোনার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। সমাজ ও দেশকে নতুন আঙ্গিকে গড়ার জন্য ছাত্রসমাজকে সঠিক পথ অনুসরণ করতে হবে। আমাদের জাতীয় উন্নয়নে সচেতন নাগরিক হিসেবে ছাত্রসমাজের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। ছাত্রসমাজ দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছাত্রসমাজই দেশ ও জাতির শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। জাতির সর্বাঙ্গীণ কল্যাণব্রত তাদের গ্রহণ করতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে জাতিকে সমৃদ্ধ করা, জাতির সমস্যা সমাধান, বিশ্বের সমাজে জাতির মর্যাদা বৃদ্ধি – এসব দায়িত্ব আজকের ছাত্রসমাজেরই। দেশের দুর্দিনে ছাত্রসমাজই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করবে। মোটকথা, জাতীয় জীবনে সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করবে ছাত্রসমাজ। জীবনের বৃহত্তর পরিসরে সে দায়িত্ব যাতে সুষ্ঠুভাবে পালন করা যায় তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আত্মস্বার্থে নিমগ্ন মানুষ যথার্থ মানুষ নয় – পরের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত জীবন সার্থক জীবন – একথা বিবেচনায় রেখে ছাত্রজীবনের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, 
‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি 
এ জীবন মন সকলি দাও, 
তার মত সুখ কোথাও কি আছে? 
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’ 

দেশাত্মবোধ :

দেশ ও জাতি তথা সমাজে কল্যাণ সাধনই ছাত্রজীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ছাত্রসমাজকে দেশাত্মবোধে অবশ্যই উদ্বুদ্ধ হতে হবে। দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি ভালোবাসা, সেবাপরায়ণ, স্বাবলম্বন, অধ্যবসায়, নিয়মানুবর্তিতা, ধর্মপরায়ণ, ধৈর্যশীল, উদার, সাহসিকতা প্রভৃতি গুণের অধিকারী হতে হবে। ছাত্রজীবনে জনসেবার বীজ উপ্ত হলে তবেই ভাবীজীবনের জন্য তা ফলপ্রসূ হবে। ছাত্রজীবনে স্বার্থত্যাগ, জনসেবা ও দেশপ্রেমের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হলে তা দেশ ও জাতির জন্য হবে কল্যাণকর। 

রাষ্ট্রের কল্যাণসাধন :

ছাত্ররা তরুণ্যের দীপ্তিতে প্রোজ্জ্বল। দেশ ও জাতি গঠনের সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তারাই পারে সাহস ও শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসতে। রাশিয়া, চীন, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের ছাত্রসমাজ দেশ ও জাতির উন্নয়নে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ছাত্রসমাজের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ছাত্রসমাজকে রাষ্ট্রের ও কল্যাণমূলক কাজে অবশ্যই যোগদান করতে হবে। দেশ ও জাতির দুর্যোগে যথাশক্তি প্রয়োগ করে অশুভ শক্তির কবল থেকে রক্ষা করা ছাত্রদের নৈতিক দায়িত্ব।

ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতা :

ছাত্রজীবন নিয়মানুবর্তিতার একটি প্রকৃষ্ট প্রয়োগক্ষেত্র এবং উপযুক্ত সময়। 
‘Work while you work, play while you play, and that is the way to be happy and gay.’ 
- এ নিয়ম ছাত্রদেররকে মেনে চলতে হবে। সুপরিকল্পিত এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ নিয়মাবলির অধীনে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর ব্যক্তিজীবন ও ছাত্রজীবন পরিচালিত হলে সে জীবনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসতে বাধ্য। নিয়ম মেনে চলতে হবে – পাঠদানে, পাঠগ্রহণে, অধ্যয়নে, তথা শিক্ষাঙ্গনের সার্বিক অবকাঠামোয়। যে ছাত্রের জীবন শৈশব থেকেই নিয়মের ছকে ঢেলে সাজিয়ে গড়া হয়, তার ভবিষ্যৎ তার অনুগামী না হয়ে পারে না। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়েই যদি নিয়মভঙ্গের মরণ–যজ্ঞ চলতে থাকে, তাহলে তার জন্যে ভবিষ্যতের গোটা সমাজকেই চরম মাশুল দিতে হয়। সাম্প্রতিককালে কিছু কিছু ছাত্রসমাজের নিয়মভঙ্গের কারণে গোটা জাতির মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রজীবন ভবিষ্যতেরই এক বিশেষ অধ্যায় মাত্র। পরবর্তী জীবনে ছাত্ররাই দায়িত্বশীল নাগরিক। তাই ছাত্রসমাজের কাছে আজও এই নিয়মানুশীলন এক মহৎ কর্তব্য।

নৈতিক মূল্যবোধ :

প্রথমেই আমরা দৃষ্টি দিই নৈতিক মূল্যবোধ বলতে কী বুঝি? নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের জীবনে অনুসরণযোগ্য এমন কিছু আচরণবিধি, যা মানুষের জীবনব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতিকে করে তোলে সুন্দর, নির্মল ও রুচি স্নিগ্ধ। এর সাথে জড়িয়ে আছে, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শ্রম, উত্তম চরিত্র, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, সর্বোপরি সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হওয়া ইত্যাদি বিশেষ কতগুলো গুণ। নৈতিক মূল্যবোধ মানব চরিত্রকে করে তোলে সুষমণ্ডিত। তাই মানুষের আত্মিক সামাজিক উৎকর্ষের জন্যে এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্যে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের লালন, চর্চা ও বিকাশের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই কারণে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে মানবচিত্তে নৈতিক মূল্যবোধের উৎসারণ এবং তার মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা। 

ছাত্রজীবনে শিষ্টাবারের গুরুত্ব :

ছাত্রজীবন হল শিষ্টাচার ও সৌজন্য আহরণের যথার্থ কাল। তার উন্মোষলগ্ন। শিষ্টাচার ও সৌজন্যের ছোঁয়াতেই ছাত্র হয় বিনীতি, ভদ্র। নতুন প্রাণ-সম্পদে হয় গৌরবন্বিত। ছাত্রজীবনে যে গুরুজনদের শ্রদ্ধা করতে শিখল না, যার উদ্ধত, দুর্বিনীত ব্যবহারে শিক্ষক বিরক্ত, যার রূঢ়, অমার্জিত আচলে সহপাঠীরা ক্ষুদ্ধ, বেদনাহত; পরবর্তী জীবনেও তার এই আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তখন সে হয় অশুভশক্তি, অকল্যাণের মূর্ত প্রতীক। হতাশা, ব্যর্থতার তিল তিল দংশন-জ্বালায় সে নিজেকে নিঃশেষ করে। আর সমাজের বুকে ছড়িয়ে দিয়ে যায় অমৃতের গরল। ছাত্রজীবনই মানুষের সুকুমারবৃত্তি লালনের শুভক্ষণ। এখানেই তার চরিত্রগঠনের ব্রত-অনুষ্ঠান। শিষ্টাচার ও সৌজন্য তো তার মনুষ্যত্ব অর্জনেরই সোপান। এরই মধ্যে আছে নিজেকে সুন্দর ও সার্থকতায় পরিপূর্ণ করে তোলার মহাশক্তি। শিষ্টাচার, সৌজন্য প্রকাশের জন্যে ছাত্রদের কিছু হারাতে হয় না, কোনো অর্থব্যয় করতে হয় না, বরং এক মহৎ অঙ্গীকারে তার সমৃদ্ধ জীবন-বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়। বিনয়ী, ভদ্র ছাত্র শুধু শিক্ষকের স্নেহই কেড়ে নেয় না, সে পায় শিক্ষকের আশির্বাদ, পায় তাঁর সাহায্য। শিষ্টাচার, সৌজন্যের অভাব ছাত্রকে দুর্বিনীত, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর করে। ধ্বংস করে তার প্রেম, মমতা, সহানুভূতি, দয়া ইত্যাদি সুকুমারবৃত্তি। এই অভাবই তাকে ঠেলে দেয় অন্যায়, অসত্যের চোরা-অন্ধকারে। সেই অন্ধকার শুধু ব্যক্তিকেই আচ্ছন্ন করে না, গ্রাস করে গোটা সমাজকে। 

উপসংহার :

ছাত্র শব্দটির যে মূল্যায়ন করা হয়, তাতে একটি সামগ্রিক মহৎ গুণাবলিই প্রতিফলিত হয় একজন ছাত্রের মধ্যে। সততা, আদর্শবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠা, উদ্যম, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ইত্যাদি বহুবিধ গুণাবলি একজন প্রকৃত ছাত্রের চরিত্রে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ছাত্ররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ - এ কথা মনে রেখে জীবন গঠনের কাজে তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে আত্মনিযোগ করতে হবে।