রচনা: আমার জীবনের লক্ষ্য / তোমার জীবনের লক্ষ্য

রচনা: আমার জীবনের লক্ষ্য / তোমার জীবনের লক্ষ্য
Admin July 16, 2024 78
সেদিন পড়াতে পড়াতে স্যার হঠাৎ বললেন, “উদ্দেশ্যবিহীন জীবন চালকবিহীন নৌকার মত।” ব্যাখা করে বুঝালেন, “চালক যদি না থাকে নৌকার পরিণাম হবে অনিশ্চিত। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে কোন্ আ-ঘাটায় সে ভেসে যাবে কে জানে? ঝড়-ঝাপটার ঘাঁয়ে হয়ত ভেঙে গুড়িয়ে যাবে- হয়ত তলিয়ে যাবে জলের অতলে। মানুষের জীবনের ক্ষেত্রেও তাই। জীবনে যদি কোন উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে জীবনের পরিণামও হবে ভয়াবহ। অন্যদিকে দুঃখ-বেদনা আঘাত যতই আসুক না কেন চালকের মতই এই উদ্দেশ্য জীবনের লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছে দেবে।”

শুনতে শুনতে কেমন যেন চমকে উঠলাম। তাইত, এমন ত কোন দিন ভাবিনি! বলেওনি কেউ কোনদিন! সত্যই ত, আমার জীবনের লক্ষ্য কি, সে নিয়ে ত কোনদিন মাথা ঘামাইনি! নিজেকে শুধোই -কি হব আমি? শিক্ষক? ইঞ্জিনিয়ার? সরকারী অফিসের বড় চাকুরে? না কি বড় ব্যবসাদার? না আরও বড় কিছু? ভেবে ভেবে থৈ পেলাম না। একবার ভাবলাম শিক্ষকই হব- স্যারের মত দরদ দিয়ে পড়িয়ে আমার গ্রামের ছেলে-মেয়েদের মানুষ করে তুলব। আবার ভাবলাম- না, বড় ব্যবসাদারই হতে হবে আমাকে। কেননা কথায় বলে “বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী।” কিংবা চিকিৎসক হওয়াও ত মন্দ না। বড় খাটুনীর জীবন হলেও সম্মানের জীবন। আহা কি সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে লোকে তাকিয়ে দেখে। দেখবেই ত। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনে যে। আবার ভাবি, আচ্ছা মন্ত্রী কিংবা উপমন্ত্রী কি হওয়া যায় না? সঙ্গে সঙ্গে মন থেকে কে যেন হুঁশিয়ার করে দেয় -ওরে, সে বড় ভাগ্যের ব্যাপার। না, সে ভাগ্য সাথে করে আসেনি, -অতএব চিন্তা করেও কাজ নেই।

বস্তুত কি যে হব- অনেক ভেবেও স্থির করে উঠতে পারছি না। চঞ্চল প্রজাপতির মত মন কেবল এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে ঘুরে ফিরে মরছিল।

ভেবে ভেবে মন যখন অস্থির, ঠিক এমকি সময় বিচিত্র এক ঘটনা ঘটল। না, বিচিত্র বললে ঠিক হবে না- মর্মান্তিক বলাই সঙ্গত। একটি ঘটনার আঘাত আমার চেতনাকে যেন নতুন এক জগতে নিয়ে গেল।

সেদিন সকালে বই নিয়ে বসে যখন তাতে মন বসাবার চেষ্টা করছি, তখন হঠাৎ করে বুকফাটা আর্তনাদে চমকে উঠলাম। কে কাঁদে এমন করে? আমাদের রূপার মা না? বই-টই ফেলে ছুটে এলাম বাইরে। ততক্ষণে বাড়ির আর সবাইও কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন। “কি হয়েছে গো? কাঁদছ কেন এমন করে?” রূপার মা যা বলল তা হল এই -ক’দিন ধরে রূপার খুব জ্বর হচ্ছিল। গত রাত থেকে খুব বাড়াবড়ি যাচ্ছে। হাঁ, ডাক্তারের কাছেও গিয়েছেন -ও পাড়ার গোপাল ডাক্তার। কিন্তু চাহিদা মত পয়সা দিতে অপারগ হওয়ায় তিনি আসতে রাজি হননি। গরীব মানুষ -দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন জোটানোই দুষ্কর। ডাক্তারের ‘ফি’-এর টাকা দেবে কোত্থেকে! এদিকে রূপার অবস্থাও সঙ্গীন। তাই ছুটে এসেছে আমাদের বাড়ি, ভাব খানা যদি আমরা কিছু ব্যবস্থা করি।

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। মানুষ এত হৃদয়হীন, এত অর্থপিশাচ হতে পারে? একটা অসহায় শিশু মরতে বসেছে জেনেও মন এতটুকু বিচলিত হয় না? এটা হয় কি করে? মাও এতক্ষণ নীরবে শুনছিলেন। আমাকে ডেকে বললেন, “খোকা, যা ত তুই, ডাক্তারকে গিয়ে বল, আমরাই ফি দিব। দেরি না করে এখ্খুনি যেন তিনি আসেন।”

মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে ছুটলাম। পেছনে পেছনে রূপার মাও কাঁদতে কাঁদতে ছুটল। ডাক্তারবাবুকে তার চেম্বারেই পেলাম। মার কথা বললাম। শুনে অপ্রসন্ন মনে তিন উঠলেন। সব গুছিয়ে নিয়ে চললেন আমাদের সাথে।

বাড়ির কাছাকাছি আসতেই রূপার মা ছুটে গিয়ে ঘরে ঢুকল। আমরাও ঢুকব এমন সয় বুকফাটা আর্তনাদে শিউরে উঠলাম। রূপার মা মাথা কুটে হাহাকার করছে -ওরে রূপারে…. লক্ষ্মী সোনা আমার….। তুই কই গেলিরে….।

স্তব্ধ হয়ে শুনলাম। বুঝলামও সব। রূপা এখন সব চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে।

কখন কিভাবে বাড়ি ফিরলাম জানি না। ঐ ঘটনা যেন চাবুকের মত ঘা দিয়ে আমাকে সজাগ করে দিল। না, জীবনের লক্ষ্য আমার ঠিক হয়ে গেছে। আমি ডাক্তার হব -হবই। শহরে নয়, ডাক্তার হয়ে এ গাঁয়েই আমি চিকিৎসা করবো রূপার মার মত যারা আর্ত - অসহায় তাদের আমি আশা দেব, ভরসা দেব। অকালমৃত্যুর হাত থেকে ওদের সন্তানদের বাঁচাবার জন্য প্রাণপ্রাত চেষ্টা করব আমি।