প্রহসন কি

প্রহসন কি
Admin December 02, 2024 217
বাঙালি সংস্কৃতিতে সাহিত্যিক এবং নাট্য ব্যঙ্গের একটি অনন্য রূপ, প্রহসন এর অর্থ আবিষ্কার করুন। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলিকে মোকাবেলা করার জন্য কীভাবে প্রহসন হাস্যরস, বিদ্রুপ এবং সমালোচনাকে মিশ্রিত করে তা জানুন। বাংলা সাহিত্যে এর উত্স, তাৎপর্য এবং উদাহরণগুলি অন্বেষণ করুন এবং নাটক ছাত্র, গবেষক বা এই কৌতূহলী শিল্প ফর্ম বুঝতে আগ্রহীদের জন্য উপযুক্ত।

প্রহসন কি?

প্রহসন বলতে বোঝায় সমাজের ত্রুটি নির্দেশক ব্যঙ্গাত্মক নাটক। এটি মূলত এক ধরনের হাস্য রসাত্মক নাটক। এর উদ্দেশ্য হলো - হাস্যরস ও ব্যঙ্গবিদ্রূপের আড়ালে অতিরঞ্জিত, অভাবনীয় ও অসংযত অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে দর্শকদের বিনোদন প্রদান করা।

নাটক ও প্রহসনের মধ্যে পার্থক্য-

নাটক এবং প্রহসন দুটোই মঞ্চে অভিনীত শিল্পকলা, তবে তাদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। নিচে দেখানো হয়েছে-

নাটক

নাটক হলো মানুষের গতিশীল জীবনের প্রতিচ্ছবি। নাটক সংলাপ নির্ভর বাস্তবসম্মত জীবনকাহিনির রূপায়ণ। নাটকের সাথে মঞ্চের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। নাটক জীবনেরই একরকম কাব্যিক প্রকাশ। অভিনয় কুশলতাই নাটকের প্রাণ। পাত্র-পাত্রীর অভিনয়ে ফুটে উঠে মানবজীবনের ঘটনাবহুল বিচিত্র পটভূমি। রস ভাব ব্যঞ্জন সহযোগে আনন্দদান নাটকের উদ্দেশ্য। নাটকে সুসংবদ্ধ কাহিনি, জীবনবাস্তবতা, পরিবেশ পরিস্থিতি হবে জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। স্থান, কাল ও ঘটনার ঐক্য নাটকের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। সাধারণত পাঁচ অঙ্কে বিভাজিত হয় নাটক।


প্রহসন
প্রহসন একপ্রকার নাট্য সৃষ্টি যেখানে হাস্যরসময় জীবনের আলেখ্য রূপায়িত হয়। সমাজের কুরীতি সংশোধনের জন্য রহস্যময় ঘটনা সংবলিত হাস্যপ্রধান একাঙ্কিকা নাটককে প্রহসন বলে। নানাবিধ সামাজিক সমস্যা, প্রাচীনপন্থি ও নব্য সমাজের মানুষের চারিত্রিক অসঙ্গতিই প্রহসনের বিষয়। উনিশ শতকের গদ্যসাহিত্যে যে ব্যঙ্গাত্মক নকশা জাতীয় রচনার সৃষ্টি হয়েছিল, মনে হয় নাটকের আঙ্গিকে সেই জাতীয় বিষয় উপস্থাপনের চেষ্টা থেকেই প্রহসনের জনন্ম।

প্রহসন বৈশিষ্ট 

‘ঋধৎপব’- এর বাংলা সমার্থক শব্দ হলো প্রহসন। সাধারণত যে নাটকে হালকা হাসি আর কৌতুকের মাধ্যমে সমাজের দোষত্রুটি তুলে ধরা হয় তাকে প্রহসন বলে। প্রহসন নাটকেরই একটি উপশাখা। সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের মতে, প্রহসন হলো সমাজের কু-রীতি শোধনার্থে রহস্যজনক ঘটনা সংবলিত হাস্যরস প্রধান একাঙ্কিকা। বর্তমানে প্রহসন বলতে একাঙ্ক কিংবা দুই অঙ্ক বিশিষ্ট অতিমাত্রার লঘু কল্পনাময়, আতিশয্যব্যঞ্জক হাস্যরসোজ্জ্বল সংস্কারমূলক নাটককে বুঝায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫জানু. ১৮২৪- ২৯জুন ১৮৭৩) যেমন আধুনিক বাংলা কবিতার মুক্তিদাতা তেমনি তিনি আধুনিক বাংলা নাটকেরও জন্মদাতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের সংখ্যা ৩টি এবং প্রহসনের সংখ্যা ২টি। তাঁর প্রথম নাটক ‘‘শর্মিষ্ঠা’’ ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত হবার পর তিনি প্রহসন রচনায় উৎসাহিত হন। তিনি একই বছরে (১৮৬০) দুটি সার্থক প্রহসন ‘‘একেই কি বলে সভ্যতা’’ ও ‘‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’’ রচনা করেন। মধুসূদনের নাটকগুলো সম্পর্কে সমালোচনা থাকলেও তাঁর প্রহসন সম্পর্কে তেমন বিরূপ সমালোচনা নেই। এর পূর্বে কেউ মদুসূদনের মতো সার্থক প্রহসন রচনা করেননি। তবে যে বিষয়বস্তু নিয়ে মধুসূদন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ রচনা করেছিলেন, ঐ একই বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর পূর্বে ‘নববাবু বিলাস’, ‘নববিবি বিলাস’, ‘‘আলালের ঘরের দুলাল’’ ইত্যাদি ব্যঙ্গাত্মক সাহিত্য রচিত হয়েছিল। কিন্তু একই বিষয় নিয়ে মধুসূদনই সর্বপ্রথম সার্থক প্রহসন রচনা করেন। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ দুই অঙ্ক বিশিষ্ট প্রহসন। প্রতি অঙ্কে দুটি করে গর্ভাঙ্ক বা দৃশ্য রয়েছে। এর পটভূমি আধুনিক কোলকাতা। পাশ্চাত্য প্রভাবিত ‘ইয়ংবেঙ্গল’ বা ‘নববাবু’দের চরিত্রদোষ উদ্ঘাটন করাই এ রচনার উদ্দেশ্য। নববাবু ও তার বন্ধুরা মিলে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ নামে একটি ক্লাব খোলে। আড্ডাই এ ক্লাবের মুখ্য উদ্দেশ্য; যেখানে অবাধে মদ্যপান ও বারবণিতাদের নিয়ে উলঙ্গ মাতামাতি চলে। নবকুমারের বাবা গোঁড়া হিন্দু বৈষ্ণব। তিনি ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে চান। কিন্তু তার বন্ধু কালীনাথ ভালোমানুষীর অভিনয় করে নববাবুর বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ওকে ক্লাবে নিয়ে যায়। তবুও নববাবুর বাবা পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে না ওদের ওপর। তাই তিনি সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বৈষ্ণব বাবাজীকে ক্লাবের উদ্দেশে পাঠান। প্রহসনটি শেষ হয়েছে ব্যঙ্গাত্মক বর্ণনা ও পথভ্রষ্ট নষ্ট যুব সম্প্রদায়ের প্রতি ধিক্কার দিয়ে। মাতাল নববাবুকে নিয়ে বৈদ্যনাথ বাড়ি ফেরার পর বাবা-মা, স্ত্রীসহ বাড়ির সকলে ছুটে আসে। নববাবু আবোল-তাবোল বকতে থাকে। পরিশেষে স্ত্রী হরকামিনীর ধিক্কারের মধ্য দিয়ে প্রহসনটি শেষ হয় : ‘‘এমন স্বামী থাকলেই বা কি আর না থাকলেই বা কি। ঠাকুর ঝি! তোকে বলতে কি ভাই, এইসব দেখেশুনে আমার ইচ্ছে করে যে গলায় দড়ি দে মরি। ছি, ছি, ছি! বেহায়ারা আবার বলে কি, যে সাহেবদের মতন সভ্য হয়েছি, হা আমার পোড়া কপাল! মদ-মাঁস খেয়ে ঢলাঢলি কল্লেই কি সভ্য হয়? একেই কি বলে সভ্যতা?’’ ‘‘একেই কি বলে সভ্যতা’’ প্রহসনের শ্রেষ্ঠত্ব হলো মধুসূদনের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রয়োগ। তিনি তৎকালীন ‘নববাবু’ বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’দের চরিত্রের মধ্যে যে দোষ-ত্রুটি লক্ষ করেছেন তা-ই নিখুঁতভাবে এখানে অঙ্কিত করেছেন। এমন সমাজবাস্তবধর্মী প্রহসন রচনা করে মধুসূদন পাঠকসমাজে ধন্য হলেও তৎকালীন ইয়ং বেঙ্গলদের কাছে তিনি রোষানলে পড়েন। ফলে সে সময়ে তিনি বেলগাছিয়া রঙ্গশালায় তাঁর প্রহসন দুটি মঞ্চস্থ করতে পারেন নি। ফরাসি নাট্যকার মলিয়েরের মতোই তাঁর ভাগ্যেও উপযুক্ত পুরস্কার মেলে নি। ‘‘একেই কি বলে সভ্যতা’’- এর অল্প সময় পরে মধুসূদন ‘‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’’ রচনা করেন। সমাজের আরও একটি বিপরীতমুখী বাস্তব চরিত্রকে অবলম্বন করে প্রহসনটি রচিত হয়। ‘‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’’-ও দুই অঙ্ক বিশিষ্ট নাটিকা। এর মূল কাহিনী সমাজের বিত্তশালী বৃদ্ধ ভক্তপ্রসাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মূলত বুড়ো বয়সে ইন্দ্রিয় আসক্তির দৌরাত্ম্য বা লাম্পট্যের স্বরূপ উন্মোচনই এ প্রহসনের উদ্দেশ্য। ভক্ত প্রসাদ ছাড়াও এখানে আছে তার অনুচর গদাধর, দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাচস্পতি, রায়ত হানিফ গাজি, হানিফের সুন্দরী স্ত্রী ফাতেমা, খল স্ত্রীচরিত্র পুঁটি আরও আছে পঞ্চী ও পঞ্চীর মা ভগি। খরার কারণে ভালো ধান না হওয়ায় হানিফ গাজি ভক্ত প্রসাদকে কীভাবে খাজনা দিবে -এ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে খাজনা কিছুটা মওকুফের জন্য গদাধরকে ধরে। এ কথা শুনে ভক্ত প্রসাদ ক্ষেপে যায়। এক পর্যায়ে গদা তার মনিবকে হানিফের সুন্দরী স্ত্রী ফাতেমার কথা বললে ভক্ত প্রসাদের রাগ কমে যায়; সে ফাতেমাকে কীভাবে ভোগ করবে ফন্দি আঁটতে থাকে। শুধু ফাতেমাই নয়, তার লাম্পট্য প্রকাশ পায় গ্রামের যুবতী মেয়ে পঞ্চীর উপর কু-দৃষ্টির মাধ্যমেও। লাম্পট্যের যে কোনো ধর্ম নেই তা নিখুঁতভাবে প্রকাশ পেয়েছে ভক্ত প্রসাদের চরিত্রে এবং এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তারই অনুচর গদাধরের স্বগত উক্তিতে। ভক্ত প্রসাদের ছেলে কোলকাতায় থাকে। সে নাকি মুসলমান বাবুর্চির রান্না খায়। এ কথা শুনে ভক্ত বলে থু!থু! বল কি হিন্দু হয়ে নেড়ের ভাত খায়। রাম!রাম! থু!থু!’’ তখন গদাধর স্বগত উক্তিতে বলে- ‘‘নেড়েদের ভাত খেলে জাত যায় কিন্তু তাদের মেয়েদের নিলে কিছু হয় না। বাঃ!বাঃ!’’ পরিশেষে ভক্ত প্রসাদ ফাতেমাকে ভোগ করার জন্য শিবমন্দিরের ভিতরে ঢোকে। কেননা ফাতেমার মতো ‘এমন স্বর্গের অপ্সরীর জন্যে হিন্দুয়ানী ত্যাগ করাই বা কোন ছার।’ কাজেই দেবালয় বা ধর্ম তার কাছে বড় ব্যাপার নয় ভোগটাই মুখ্য। তবে হানিফ গাজি ও বাচস্পতির বুদ্ধি ও কৌশলের কাছে সে হার মানে ফাতেমাকে ভোগ করতে পারে না। ‘‘একেই কি বলে সভ্যতা’’- এ মধুসূদন যেমন শহরের ক্ষয়িষ্ণু সমাজচিত্র অঙ্কন করেছেন তেমনি গ্রামের সামাজিক অসংগতি ও মানুষের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়কে তিনি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন ‘‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’’ প্রহসনে। তাঁর সৃষ্টির দিক দিয়ে এ প্রহসনটি পূর্বের প্রহসন ‘‘একেই কি বলে সভ্যতা’’-এর চেয়ে অধিকতর মূল্যবান। এখানে চরিত্র সৃষ্টি এবং তাদের মুখের সংলাপ যেমন সার্থকতা অর্জন করেছে তেমনি এখানে কবিতা বা ছড়া ব্যবহার করে ভাষাকে আরো সরস ও প্রাণবন্ত করে তোলা হয়েছে। সমালোচক দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘মধুসূদনের।