অপরিচিতা গল্পের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর

Admin
November 30, 2024
511
এই উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হল প্রেম, নারীর স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায় এবং সমাজের কঠোর সামাজিক পরিবেশের বিপর্যয়ের সমস্যার উপর ভিত্তি করে রচিত। সুভা নামের একটি যুবতীর কথা বলা হয় যার জীবনের অভিজ্ঞতা এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়।
অপরিচিতা গল্পের সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর
১ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্ন
১। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের শিক্ষিত ছেলে কৌশিকের মা-বাবা তার মতামত না নিয়েই সুরবালার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে। সুরবালার বাবার অঢেল সম্পদ৷ গোপনে ঘটকের মধ্যস্থতায় এ বিয়েতে বরপক্ষকে নগদ টাকা, গাড়ি এবং ঢাকার অভিজাত এলাকায় একটি ফ্ল্যাট দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যৌতুকের বিষয়টি জানতে পেরে কৌশিক ও সুরবালা বেঁকে বসে এবং সম্পূর্ণ যৌতুকবিহীনভাবে পরস্পর বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ক) অনুপমের বাবার পেশা কী ছিল?
খ) “এই তো আমি জায়গা পাইয়াছি।” ব্যাখ্যা কর।
গ) উদ্দীপকের কৌশিকের সঙ্গে ‘অপরিচিতা’ গল্পের অনুপমের তুলনা কর।
ঘ) “উদ্দীপকে ‘অপরিচিতা’ গল্পে বর্ণিত সামাজিক অসঙ্গতি অনেকাংশেই প্রতিফলিত।” যাচাই কর।
১ নং প্রশ্নের উত্তর
ক) অনুপমের বাবার পেশা ছিল ওকালতি।
খ) এই তো আমি জায়গা পাইয়াছি’—উক্তিটি দ্বারা কল্যাণীর কাছাকাছি থাকতে পেরে, তাকে দেখতে পেরে, তার কিছু কাজ করে দিতে পেরেই অনুপম নিজেকে সুখী ও সার্থক ভাবে —এই মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে। মায়ের সাথে যাত্রাপথে গাড়িতে উঠার সময় কল্যাণীর কণ্ঠে অনুপম প্রথম শুনতে পায় ‘জায়গা আছে’ কথাটি। ‘জায়গা আছে’ কথাটি অনুপমের কাছে চিরজীবনের গানের ধুয়া হয়ে রয়েছে। কল্যাণীকে বিয়ে করতে পারেনি বলে অনুপমের কোনো কষ্ট নেই, বরং সুযোগ হলে তার ছোটখাটো কাজ পর্যন্ত সে করে দেয়। আর মনে মনে ভাবে, এই তো সে জায়গা পেয়েছে। যদিও তার সম্পূর্ণ পরিচয় পায়নি, আজও সে অপরিচিতা; তবুও ভাগ্য ভালো যে, সে জায়গা পেয়েছে।
গ) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও আত্মমর্যাদার দিক দিয়ে উদ্দীপকের কৌশিকের সঙ্গে ‘অপরিচিতা’ গল্পের অনুপমের কোনো মিল নেই। উদ্দীপকে দেখা যায়, কৌশিক শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের সন্তান। কৌশিকের মা-বাবা তার মতামত না নিয়েই ধনাঢ্য পরিবারের কন্যা সুরবালার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে। মা-বাবার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়ে সুবোধ বালকের মতো কৌশিক তা মেনেও নেয়। কিন্তু গোপনে যৌতুক গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে জানতে পেরে কৌশিক বিদ্রোহ করে বসে।
যৌতুককে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে পাত্র-পাত্রী, উভয়ে পরস্পরকে যৌতুকবিহীনভাবে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, কৌশিক মা-বাবার পছন্দকৃত পাত্রীকে বাধ্যগত সন্তানের মতো মেনে নিলেও কোনো সামাজিক অনাচার বা ঘৃণ্য প্রথাকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তার এরূপ বীরোচিত সিদ্ধান্তকে পাঠকমাত্রই সশ্রদ্ধচিত্তে সাধুবাদ জানাবে। উদ্দীপকের কৌশিকের সাথে ‘অপরিচিতা’ গল্পের অনুপমের ব্যক্তিত্বের কোনো মিল নেই। গল্পের অনুপম যেন তার মামার হাতের পুতুল। মামার মতামতের ওপর ভিত্তি করে তার সকল ভালোলাগা-মন্দলাগা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, মতামতের জলাঞ্জলি দিতে হয়।
মামার অন্যায্য যৌতুকের দাবি ও তা আদায়ের কদর্য ভঙ্গি অনুপম মুখ বুজে মেনে নিয়েছে। ফলে মনের মানসীকে পাওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে তার। নির্লজ্জের মতো তাকে বর বেশে ফিরে আসতে হয়েছে বিয়ে বাড়ি থেকে। কনের বাবা তার মতামত জানতে চাইলেও সে থেকেছে নির্বাক, নিস্তব্ধ। তার এই মেরুদণ্ডহীনতা পাঠককুলকে হতাশ করে। তাই বলা যায, প্রয়োজনের মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে কৌশিকের ব্যক্তিমর্যাদা যে অনন্য উচ্চতায় আসীন, সেই একই ক্ষেত্রে স্বকীয় সিদ্ধান্তের অভাবে অনুপমের চরিত্র মলিন ও নিষ্প্রভ রূপে ধরা পড়ে।
ঘ) উদ্দীপকে ‘অপরিচিতা’ গল্পে বর্ণিত সামাজিক ব্যাধি যৌতুক প্রথার ছায়াপাত ঘটেছে। সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি কুপ্রথার নাম যৌতুক। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে এই কাল নাগিনীর বিষ। প্রতি বছর হাজারো নারী যৌতুকের নিঠুর বলি হয়ে জীবন দিচ্ছে। অনেক নারী বেঁচে থেকেও মরে আছে। সমাজের কোনো শ্রেণি বা অবস্থানের মানুষই যে যৌতুকের করাল থাবা থেকে মুক্ত নয়, তারই প্রমাণ বহন করে উদ্দীপক ও আলোচ্য গল্পটি।
উদ্দীপকের ক্ষুদ্র প্রেক্ষাপটে যৌতুক প্রথার সকরুণ চিত্র উপস্থাপিত। আর্থিকভাবে সচ্ছল কৌশিকের পরিবার এখানে যৌতুক গ্রহণের অভিপ্রায়ে দণ্ডিত। যদিও শিক্ষিত ছেলে কৌশিকের নিকট মা-বাবার এমন অভিলায গ্লানিকর ঠেকেছে। একে সে দেখেছে স্বীয় ব্যক্তিত্বের বিসর্জন হিসেবে। তাইতো এই আত্মপ্রত্যয়ী যুবক পেরেছে সমাজের প্রচলিত ঘৃণ্য রীতি-নীতিকে ভাঙতে। এদিকে তার পাত্রী সুরবালার বাবা কিন্তু যৌতুককে অলঙ্ঘনীয় প্রথা হিসেবেই মেনে নিয়েছিলেন। তাই তো কন্যাকে পাত্রস্থ করার লক্ষ্যে অর্থ-কড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট প্রদানেও পিছপা হননি। তবে একে নারীত্বের অবমাননা জ্ঞান করে সুরবালাও কৌশিকের মতো যৌতুকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। তবে উদ্দীপক থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, রাষ্ট্র ও সভ্যতাবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও যৌতুকের ন্যায় সামাজিক অসঙ্গতি আজও দোর্দণ্ড প্রতাপের সাথে আমাদের সমাজে বিরাজমান।
অনুরূপভাবে বিয়ে উপলক্ষে যৌতুক নিয়ে নারীর চরম অবমাননার প্রতিবাদ ‘অপরিচিতা’ গল্পটির অন্যতম উপজীব্য। গল্পে যৌতুক নিয়ে কল্যাণীর চরম অবমাননাকালে তার ব্যক্তিত্বরহিত বর পরিবারতন্ত্রের কাছে অসহায় পুতুল হয়ে থেকেছে। আসলে, সমাজে জেঁকে বসা পণপ্রথা যে পুরুষতন্ত্রেরই হাতিয়ার, নারীত্বের অবমাননার দলিল গল্পটি পড়ে সে কথা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। আত্মমর্যাদাশীল কল্যাণী ও তার বাবা তাই সে বিয়ে ভেঙে দিতে একটুও কসুর করেনি। তবে বর্তমান পৃথিবী একবিংশ শতকে প্রবেশ করলেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় যে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি উদ্দীপকের ঘটনাই তার প্রমাণ। পরিশেষে বলা যায়, উদ্দীপকটি ‘অপরিচিতা’ গল্পে বর্ণিত সামাজিক অসঙ্গতিরই প্রতিফলিত চিত্র।
২ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্ন
২। গৌরী ও সঞ্জয় অনেকদিন ধরে একই অফিসে চাকরি করছে, কিন্তু সহকর্মীরা জানে না দুজনার অন্তরে গভীর ক্ষত। গৌরীকে নিজে পছন্দ তাই করে বিয়ে করতে চেয়েছিল সঞ্জয়। বছর পাঁচেক আগে লোক খাওয়ানো নিয়ে বিয়ে ভেঙেছে তাদের। পিতৃহীন সঞ্জয় কাকার আশ্রয়ে মানুষ, তার দোষ জেনেও প্রতিবাদ করতে পারেনি। একদিন গৌরীর কাছে নিজের অসহায় অবস্থার কথা তুলে ধরে সঞ্জয়। বলে, তার জন্য সে সারা জীবন অপেক্ষা করবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গৌরী বলে, “কী দরকার, এই তো বেশ আছি।”
ক) কোন কথা স্মরণ করে অনুপমের মামা ও মা ‘একযোগে বিস্তর হাসিলেন’?
খ) “মেয়ের চেয়ে মেয়ের বাপের খবরটাই তাহার কাছে গুরুতর” —উক্তিটি বুঝিয়ে লেখ।
গ) উদ্দীপকের সঞ্জয় ‘অপরিচিতা’ গল্পের কোন চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে? বুঝিয়ে দাও।
ঘ) “এই তো বেশ আছি!” গৌরীর এই উক্তিতে ‘অপরিচিতা’ গল্পের পরিণতি প্রতিফলিত হয়েছে”।
২ নং প্রশ্নের উত্তর
ক) গায়েহলুদের বাহকদের বিদায় করতে কনেপক্ষকে যে নাকাল হতে হবে, সে কথা স্মরণ করে অনুপমের মামা ও মা ‘একযোগে বিস্তর হাসিলেন’।
খ) অনুপমের জন্য তার মামার বিস্তর পণসমেত দাসীরূপী কনে পাওয়ার অভিপ্রায় বোঝাতে প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করা হয়েছে। —উক্তিটি মূল্যায়ন কর। অনুপমের মামা ভাগনের জন্য এমন কনে আনতে চান, যে ধনীর কন্যা নয়, কিন্তু যার বাবা পণ হিসেবে টাকা দিতে কসুর করবে না। এতে করে তাকে শোষণ করা চলবে, কিন্তু কোনো কিছুতেই প্রতিবাদ করবে না। ধনীর কন্যা হলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমস্যা হতে পারে। তাই মেয়ের চেয়ে মেয়ের বাপের খবরটাই অনুপমের মামার কাছে অধিক গুরুতর।
গ) উদ্দীপকের সঞ্জয় ‘অপরিচিতা’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র অনুপমের প্রতিনিধিত্ব করে। উদ্দীপকের সঞ্জয় তার মানসপ্রিয়া গৌরীর সাথে একই অফিসে চাকরি করে। অফিসের কেউ জানে না পাঁচ বছর আগে তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পিতৃহীন সঞ্জয়ের অভিভাবক কাকার দোষে সেই বিয়ে ভেঙে যায়। মানসিক দৃঢ়তার অভাবে সঞ্জয় সেই সময় কাকার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেনি।
বহুদিন পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে গৌরীর কাছে নিজের অসহায় অবস্থার কথা তুলে ধরে। বলে, তার জন্য সে সারা জীবন অপেক্ষা করবে। তবে এমন প্রস্তাবে গৌরী সাড়া দেয়নি। সঞ্জয়ের মতো অনেকটা একই রকম ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে যেতে দেখা যায় ‘অপরিচিতা’ গল্পের অনুপমকে। সঞ্জয়ের মতোই অনুপমেরও বিয়ের পাত্রীর প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা ছিল। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে সে মামার অন্যায় সিদ্ধান্তই মেনে নেয়। অন্যায় জেনেও সে যৌতুকের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ জানাতে পারেনি।
নিজের বিয়ের বিষয়েও কোনো দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে সেই বিয়ে ভেঙে যায়। বহুদিন পরে সেই পাত্রী কল্যাণীকে কাছে পেয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে অনুপম। কিন্তু তত দিনে কল্যাণী দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত, বিয়েতে অনাগ্রহী। তাই কল্যাণীর সাহচর্য পেয়েও অনুপমের সে মানসপ্রিয়া চির অপরিচিতই থেকে যায়। সুতরাং বলা যায়, যথাসময়ে সঠিক অবস্থান নিতে না পারায় একই ধরনের পরিণতি ভোগ করার দিক থেকে উদ্দীপকের সঞ্জয় ও গল্পের অনুপম সমার্থক চরিত্রের অধিকারী।
ঘ) “এই তো বেশ আছি।’ গৌরীর এই উক্তিতে ‘অপরিচিতা’ গল্পের পরিণতি প্রতিফলিত হয়েছে” —উক্তিটি যুক্তিসঙ্গত। জীবনে প্রাপ্তিই শেষ কথা নয়। অনেক সময় প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাও পরম তৃপ্তি দিতে পারে। না পাওয়ার যে বেদনা তা-ও ম্লান হয়ে যায় এই স্বর্গীয় অনুভূতির কাছে। উদ্দীপকের গৌরীর উক্তি ‘এই তো বেশ আছি।’ আর গল্পের অনুপমের অনুভব ‘এই তো জায়গা পাইয়াছি।’ তাই সমার্থক হয়ে ওঠে।
উদ্দীপকের গৌরীকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চেয়েছিল সঞ্জয়। কিন্তু তার কাকার অনাকাঙ্ক্ষিত এক ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে ভালোবাসার মানুষটির সাথে স্বর্গীয় বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেনি সে। সঞ্জয়ের এই ব্যর্থতায় গৌরী নিজেও বুকে ক্ষত চাপা দিয়ে বেঁচে আছে। পাঁচ বছর পর সঞ্জয় সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলে গৌরী বাধা দেয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘কী দরকার, এই তো বেশ আছি।’ নিরুপায় সঞ্জয় গৌরীকে বিয়ে করতে না পারলেও সারাজীবন তার পাশে থাকার অঙ্গীকার করে। উদ্দীপকের সঞ্জয়ের অনুরূপ পরিণতি গল্পের অনুপম আর কল্যাণীও বরণ করেছে। অনুপম চোখে না দেখেও ভালোবেসেছে কল্যাণীকে। স্বপ্ন দেখেছে তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার। কিন্তু বিয়ের আসরে মামার এক ভুলের খেসারত দিয়ে হাতছাড়া করেছে কল্যাণীকে।
অনুপম অপরিপক্বতার পরিচয় দিলেও কল্যাণী আর নিজেকে সংসারে জড়াতে চায়নি। ‘নারীশিক্ষার ব্রতকে নিজের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। বহুদিন পর কল্যাণীকে আবার খুঁজে পায় অনুপম। নিজের জীবনে সে আর কোনো নারীকে কামনা করেনি। কল্যাণীও আর কাউকে কল্পনা করেনি কোনো দিন। পরিবারের শত বাধা উপেক্ষা করে অনুপম ছুটে গেছে কানপুরে কল্যাণীর কর্মক্ষেত্রে। বিয়ের আশা না করলেও সব সময় কল্যাণীর পাশে থাকবে এটাই তার চাওয়া। অজানা কন্ঠের মধুর সুর বছরের পর বছর তাকে বিস্ময়াভিভূত করে রেখেছে। তাদের দেখা হয়। কণ্ঠ শোনে। যখন সুবিধা পায় কল্যাণীর কাজ করে দেয়ে অনুপম। যা করে কল্যাণীর মনে একটু জায়গা চায় সে। প্রেমিকার মন-মন্দিরে একটুখানি জায়গা পেয়েই সে স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করে। সুতরাং বলা যায়, উদ্দীপকের সঞ্জয় ও গৌরী এবং গল্পের অনুপম ও কল্যাণীর জীবনধারা অনেকটা একই পথে ধাবমান।
৩ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্ন
৩। হয়তো কিছুই নাহি পাব
তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালবেসে যাব।।
যদি ওগো কাদে মোর ভীরু ভালবাসা,
জানি তুমি বুঝিবে না তবু তারি ভাষা,
তোমারি জীবনে কাঁটা আমি, কেন মিছে ডাব।।
ক) ‘অপরিচিতা’ গল্পটি প্রথম কোথায় প্রকাশিত হয়?
খ) ‘তারপর বুঝিলাম, মাতৃভূমি আছে।’—বুঝিয়ে লেখ।
গ) উদ্দীপকের কথকের মনের ভাব ‘অপরিচিতা’ গল্পের অনুপমের মনোভাবের সাথে কতটুকু সম্পর্কিত? আলোচনা কর।
ঘ) উদ্দীপকে ‘অপরিচিতা’ গল্পের আংশিক ভাব প্রতিফলিত হয়েছে বিশ্লেষণ কর।
৩ নং প্রশ্নের উত্তর
ক) ‘অপরিচিতা’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায়।
খ) অনুপম কল্যাণীর স্বদেশপ্রেম সম্পর্কে আলোচ্য কথাটি বলেছে। অনুপমের সাথে কল্যাণীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সেই বিয়ে ভাঙার পর থেকে কল্যাণী পণ করেছে কোনো দিন বিয়ে করবে না। দেশের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার ব্রতে কল্যাণী ত্যাগ করেছে জাগতিক মোহ। দেশমাতার সেবায়, মেয়েদের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তার এই প্রতিজ্ঞা থেকে কেউ তাকে এক বিন্দু টলাতে পারেনি। কল্যাণীর এভাবে মাতৃভূমির চরণে নিজেকে সঁপে দেওয়া প্রসঙ্গে অনুপম প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি করেছে।
গ) উদ্দীপকের কথকের মনের ভাব ‘অপরিচিতা’ গল্পের অনুপমের মনোভাবের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কিত। প্রকৃত প্রেম বিনিময় প্রত্যাশী নয়। আর সব প্রেম পরিণয় পর্যন্তও গড়ায় না। তবে তাতে প্রকৃত প্রেমিকের কিছুই যায় আসে না। প্রেমের আগুনে পোড়া মন কেবল ভালোবাসার তৃপ্ততা পেলেই শান্ত হয়। উদ্দীপকের কথক এমনই প্রেমমালা গেঁথেছেন প্রেমিকার তরে। ভীরু প্রেমিকের ক্রন্দন প্রেমিকা বুঝতে অপারগ হবে এটাই স্বাভাবিক, তবে নিজেকে কাঁটা ভেবে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা সহজেই পাঠক হৃদয়ে উত্তীর্ণ হয়। ধন্য এই প্রেম, ধন্য এই প্রেমিকার জীবন। অনেকটা একই রকম নিষ্কাম প্রেমের মূর্ছনা ‘অপরিচিতা’ গল্পের পরিণতিকে অনন্য করে তুলেছে।
আলোচ্য গল্পের অনুপমের মনে প্রেমের আবেশ ছড়িয়েছিল তার সাথে বিয়ে হতে যাওয়া কল্যাণী। যৌতুকলোভী মামার সিদ্ধান্ত অধোবদনে মানতে গিয়েই কল্যাণীকে বিয়ে করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে অনুপম। পরবর্তীকালে কল্যাণীর সাথে সাক্ষাৎ হলে অনুপমের মনের সেই আকর্ষণ তীব্র মোহে পরিণত হয়। বিয়ের আশা না করলেও দূর থেকে ভালোবেসে কল্যাণীর পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। দেখা হয়। কণ্ঠ শোনে। প্রেমিকার মন-মন্দিরে একটুখানি জায়গা পেয়েই সে স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করে। তাই বলা যায়, অনুপমের মনে বয়ে চলা ভাবই যেন কাব্যরূপ পেয়েছে উদ্দীপকের চরণমালায়।
ঘ) উদ্দীপকে ‘অপরিচিতা’ গল্পের অন্যতম দিক কামনাশূন্য প্রেমিকের বিরহী ভাব প্রতিফলিত হয়েছে মাত্র। ‘অপরিচিতা’ গল্পটি বিশ শতকের সূচনা লগ্নের সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে রচিত। এই গল্পে যৌতুক প্রথার ঘৃণিত রূপ যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি আছে এর বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের কথকতাও। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে গল্পটিকে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে এক ভীরু কাপুরুষের অপরিণত ভালোবাসার উপাখ্যান।
উদ্দীপকে এক আপাত ব্যর্থ প্রেমিক হৃদয়ের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে। মনের অব্যক্ত কান্না আর প্রেমিকার প্রতি অপ্রতিরোধ্য ভালোবাসাই যার সম্বল। এই প্রেম একমুখী ও দূরাশ্রয়ী, প্রেমিকার বোধের অগম্য। তবে তাতে ভালোবাসার ঘাটতি পড়ে না এতটুকু, কেননা ভালোবাসার জন্ম প্রতিদানের আশা থেকে হয় না। নায়িকা কল্যাণীর প্রতি এমনই সকরুণ প্রেমঘন হৃদয়ের আর্তি প্রকাশ পেয়েছে আলোচ্য গল্পের অনুপমের মনেও। তবে তা গল্পের সামগ্রিক ভাবের অতি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। আলোচ্য গল্পটির সূচনা এক শিক্ষিত ছেলের ব্যক্তিত্বহীনতা ও পরিবারতন্ত্রের কাছে তার অসহায় নতি স্বীকারের মধ্য দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে বিয়ে উপলক্ষে যৌতুক নিয়ে নারীর চরম অবমাননার প্রতিবাদ গল্পটির অন্যতম উপজীব্য হয়ে উঠেছে। কন্যার লগ্নভ্রষ্ট হওয়ার লৌকিকতাকে অগ্রাহ্য করে পিতা শম্ভুনাথ সেনের নির্বিকার অথচ বলিষ্ঠ প্রত্যাখ্যান নতুন এক সময়ের আশু আবির্ভাবকেই সংকেতবহ করে তোলে।
গল্পের শেষাংশে কর্মীর ভূমিকায় আত্মপ্রত্যয়ী কল্যাণীর আত্মপ্রকাশও নারী জাগরণের ইঙ্গিতবহ। আর সবশেষে গল্পটি রূপ নিয়েছে মনস্তাপে ভেঙে পড়া এক ব্যক্তিত্বহীন যুবকের অকপট স্বীকারোক্তির অনন্য পক্তিমালায়। তার জবানিতে পুরুষতন্ত্রের অমানবিকতার স্ফুরণ যেমন ঘটেছে, তেমনি নারীর প্রশস্তিও কীর্তিত হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, আলোচ্য গল্পের বিস্তৃত কাহিনিপটের অতি সামান্য অংশই উদ্দীপকে বিধৃত হয়েছে।