মহিলাদের সালাতুল তাসবিহ নামাজের নিয়ম

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম অনেকের জানা নাই। অনেকেই জানেন না কখন ও কিভাবে এই নামাজ পড়তে হয়। তাই আজকে আমরা আলোচনা করবো সালাতুল তাসবিহ নামাজের নিয়ম, মহিলাদের সালাতুল তাসবিহ নামাজের নিয়ত, কিভাবে সালাতুল তাসবিহ নামাজ পড়তে হয়, সালাতুল তাসবিহ নামাজের সময়, সালাতুল তাসবিহ নামাজের ফজিলত, সালাতুল তাসবিহ নামাজের দোয়া, সালাতুল তাসবিহ নামাজ সুন্নত না নফল, এসব বিষয়ে আজকে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এই সালাতুত তাসবিহ নামাজ অনেক ফজিলতপূর্ণ নামাজ। তাই নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই নামাজ প্রতিদিন একবার, নয়তো সপ্তাহে একবার, নাহয় মাসে একবার, এমনকি জীবনে একবার হলেও পড়তে বলেছেন।
সালাতুত তাসবিহ নামাজের ফজিলত
এক সাহাবী বলেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, "তুমি আগামীকাল সকালে এসো, আমি তোমাকে একটি বখশিশ দিব, একটি জিনিস দিব, একটি বস্তু দান করব।" সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, "এই কথার দ্বারা আমি মনে করলাম, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে কোন পার্থিব সম্পদ দান করবেন।" আমি পরদিন এসে হাজির হলে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমালেন, "দুপুরে যখন সূর্য হেলিয়া যায় তখন চার রাকাত সালাতুত তাসবিহ নামাজ পড়িও।" আর এটাও বললেন যে, "তুমি যদি সারা দুনিয়ার মানুষের চাইতে বেশী গোনাহগার হও তবু তোমার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।" আমি আরজ করলাম, "যদি ঐ সময়ে পড়তে না পারি?" হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমাইলেন, "দিনে অথবা রাতে যে কোন সময় পার পড়ে লইও।" (আবু দাউদ)
হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, "আমাকে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, 'আমি তোমাকে একটি বখশিশ দিব, একটি উপহার দিব, একটি জিনিস দান করব?'" হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, "আমি মনে করলাম, দুনিয়ার এমন কোন জিনিস তিনি আমাকে দেওয়ার ইচ্ছা করছেন যা আর কাউকে দেন নাই।" (এই কারণে এই ধরনের শব্দগুলো বখশিশ, উপহার ইত্যাদি বারবার বলতেছেন) অতঃপর তিনি আমাকে চার রাকাত সালাতুত তাসবিহ নামাজ শিখালেন। এতে এই কথাও বলছেন যে, "যখন আত্তাহিয়্যাতু’র জন্য বস তখন প্রথমে এই তসবীহগুলি পড়ে নিবে পরে আত্তাহিয়্যাতু পড়বে।" (শরহে এহয়া : দারা কুতনী, আবু নুআইম)
হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন চাচাত ভাই হযরত জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহু কে হাবশায় পাঠিয়েছিলেন। হাবশা হতে মদীনায় ফিরে আসার পর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাথে কোলাকুলি করলেন এবং কপালে চুম্বন করলেন। অতঃপর এরশাদ ফরমালেন, "আমি তোমাকে একটা জিনিস দিব, একটা সুসংবাদ শুনাব, একটা বখশিশ দিব, একটা উপহার দিব?" হযরত জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "অবশ্যই দিন।" হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমালেন, "চার রাকাত নামাজ পড়।" অতঃপর উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করলেন। এই হাদিসে উক্ত চার কালেমার সাথে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজীম’ও পড়ার কথা এসেছে। (হাকেম)
আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু কে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস! হে আমার চাচা! আমি কি আপনাকে একটা দান, একটা বখশিশ দিব? একটা জিনিস বলে দিব? আপনাকে দশটি জিনিসের মালিক বানাব? যখন আপনি এই কাজটা করবেন, তখন আল্লাহ তায়ালা আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের গোনাহ, নতুন ও পুরাতন গোনাহ, ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত গোনাহ, সগীরা ও কবীরা গোনাহ, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গোনাহ সব মাফ করে দিবেন। সে কাজটি হল এই যে, চার রাকাত নফল নামাজ (সালাতুত তসবীহের নিয়ত বাঁধিয়া) পড়ুন। যদি সম্ভব হয় তবে প্রতিদিন একবার এই নামাজ পড়ে নিবেন। যদি না হয় তবে জুমার দিনে একবার পড়বেন। তাও যদি না হয় তবে মাসে একবার পড়বেন। তাও যদি না হয় তবে প্রতি বছর একবার পড়বেন। তাও যদি না হয় তবে সারা জীবনে একবার হলেও এই নামাজ অবশ্যই পড়বেন। (মিশকাত: আবু দাউদ, তিরমিযী)”
সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম
সালাতুত তাসবিহ নামাজের প্রথম নিয়ম:
১) প্রথমে ওজু করে পাক-পবিত্র হয়ে, পবিত্র স্থানে দাঁড়িয়ে কেবলামুখী হয়ে (মুখে উচ্চারণ করে বলবেন বা মনে মনে এই নিয়ত করবেন যে, আমি কেবলামুখী হয়ে চার রাকাত সালাতুত তাসবিহ এর নফল নামাজ আদায় করতেছি)
২) তারপর উভয় হাত কানের লতি বরাবর (মেয়েদের কাঁধ বরাবর হাত উঠাবেন) উঠিয়ে আল্লাহু আকবার বলে নাভির নিচে (মেয়েদের বুকের উপর) হাত বাঁধবেন এবং বাম হাতের উপর ডান হাত রাখবেন।
৩) এবার ছানা পড়তে হবে (সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়া তাআলা জাদ্দুকা ওয়া লা-ইলাহা গাইরুক।
৪) তারপর আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রাজিম ও বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়ে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে।
৫) সূরা ফাতিহা শেষ করার পর যেকোনো একটি সূরা পাঠ করতে হবে এবং তার সাথে যেকোনো একটি সূরা পড়তে হবে (চার রাকাতেই সূরা ফাতিহা পড়ার পর অন্য একটি সূরা পড়তে হবে)।
৬) সূরা মিলানোর পর রুকুতে যাওয়ার আগে ১৫ বার (سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا اِلهَ اِلَّا اللهُ اللهُ اَكْبَرُ) ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে।
৭) অতঃপর রুকুতে যাওয়ার পর রুকুর তাসবিহ পড়তে হবে এবং ১০ বার ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে।
৮) রুকু হতে উঠার সময় পড়বেন “সামি আল্লাহু লিমান হামিদাহ্” এবং সুজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বেন “রব্বানা লাকাল হামদ”। রুকু হতে দাঁড়ানো অবস্থায় (হাত ছাড়া থাকবে) ১০ বার উক্ত তাসবিহটি পড়তে হবে।
৯) তারপর আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যেতে হবে। সিজদায় যাওয়ার পর সিজদার তাসবিহ পড়তে হবে এবং ১০ বার তাসবিহটি পড়তে হবে।
১০) দুই সিজদার মাঝে বসে ১০ বার পড়তে হবে।
১১) আবার সিজদায় যাওয়ার পর সিজদার তাসবিহ পড়তে হবে এবং ১০ বার তাসবিহটি পড়তে হবে।
১২) দ্বিতীয় সিজদা হতে মাথা উঠিয়ে বসতে হবে (দ্বিতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়ানোর পূর্বে) তাসবিহটি ১০ বার পড়তে হবে।
এভাবে প্রতি রাকাতে মোট ৭৫ বার হবে। এভাবে প্রতি রাকাতে ৭৫ বার করে পড়তে হয়। চার রাকাতে সর্বমোট ৩০০ বার হবে।
বিঃদ্রঃ দ্বিতীয় রাকাত পরে যখন বসবেন তখন আত্তাহিয়্যাতু পড়ার আগে তাসবিহটি ১০ বার পড়তে হবে, তারপর আত্তাহিয়্যাতু পড়বেন এবং তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়াবেন। এমনিভাবে চতুর্থ রাকাত পরে যখন বসবেন তখন তাসবিহটি ১০ বার পড়ে তারপর আত্তাহিয়্যাতু, দুরুদ এবং দোয়া মাশুরা পড়ে সালাম ফিরাবেন। উপরের এই পদ্ধতি মিশকাতঃ আবু দাউদ, তিরমিযী শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে।
সালাতুত তাসবিহ নামাজের দ্বিতীয় নিয়ম
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহঃ) ও অন্যান্য বহু ওলামায়ে কেরাম হইতে এই নামাজের ফজিলত নকল করা হয়েছে এবং তাহাদের পক্ষ হতে এই তরীকা বর্ণিত হয়েছে যে,
১) নিয়ত বেধে ছানা পড়ার পর ১৫ বার ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। তারপর আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রাজিম ও বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়ে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে এবং অন্য যেকোন একটি সূরা মিলানোর পর রুকুতে যাওয়ার পূর্বে ১০ বার তাসবিহটি পড়তে হবে (দাঁড়ানো অবস্থাতেই ২৫ বার হয়ে যাবে)।
২) অতঃপর রুকুতে যেতে হবে এবং রুকুর তাসবিহ পড়তে হবে। তারপর ১০ বার তাসবিহটি পড়তে হবে।
৩) রুকু হতে উঠে দাঁড়ানো অবস্থাতে ১০ বার পড়তে হবে।
৪) সিজদায় যেয়ে সিজদার তাসবিহ পড়তে হবে এবং ১০ বার উক্ত তাসবিহ পড়তে হবে।
৫) দুই সিজদার মাঝে বসে ১০ বার পড়তে হবে।
৬) আবার সিজদায় যাওয়ার পর সিজদার তাসবিহ পড়তে হবে এবং ১০ বার তাসবিহটি পড়তে হবে। তারপর আল্লাহু আকবার বলে দ্বিতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যাবেন। এভাবে মোট ৭৫ বার হয়ে যাবে।
উক্ত নিয়মটি তিরমিযী শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে।