কুরবানির ইতিহাস
Admin
November 07, 2024
64
কুরবানি শব্দটি ‘কুরবুন’ মূল ধাতু থেকে নির্গত। অর্থ হলো- নৈকট্য লাভ করা, প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা।
শরিয়তের পরিভাষায়-নির্দিষ্ট জন্তুকে একমাত্র আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিয়মে মহান আল্লাহ পাকের নামে জবেহ করাই হলো কুরবানি। কুরবানি ইসলামের অন্যতম এক নিদর্শন, তার হুকুমের ব্যাপারে ইমামদের মতবিরোধ রয়েছে। জমহুর উলামাদের নিকট সুন্নতে মুয়াক্কাদা, হানাফি মাযহাবের মতে ওয়াজিব।
এখন কথা হলো কুরবানি কারা করবে? যারা জিলহজ্জ মাসের দশ, এগারো, ও বারো তারিখে নিজেদের নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ ব্যতিত অতিরিক্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা এর সমমূল্যের মালিক হয়, তাহলে তাদের উপর কুরবানী করা আবশ্যক। অর্থ্যাৎ যারা এই তিনদিনে ৫৮,১৭০ টাকার মালিক থাকবে।
কোরবানির ইতিহাস
(১) পৃথিবীর ইতিহাসে হযরত আদম আ. এর দুই পুত্রের কুরবানির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর কুরবানি সূচনা হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আর তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করল। অতঃপর তাদের একজন থেকে গ্রহণ করা হল, আর অপরজন থেকে গ্রহণ করা হল না।
সে বলল, ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব’। অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের থেকে গ্রহণ করেন’। (সূরা মায়েদা-২৭) যদি তুমি আমার প্রতি তোমার হাত প্রসারিত কর আমাকে হত্যা করার জন্য, আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য আমার হাত তোমার প্রতি প্রসারিত করব না। নিশ্চয় আমি সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহকে ভয় করি’। (সূরা মায়েদা-২৮)
(২) মুসলিম উম্মাহর জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আ. এর পুত্র হযরত ইসমাইল আ. কে কুরবানি করার মাধ্যমে দ্বিতীয় ইতিহাসের এক নতুন মাত্রা তৈরি হয়। তবে ইসলামে হযরত ইসমাইল আ.এর স্বরনে কুরবানি করা হয়।
কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসে ইরশাদ করেছেন , কুরবানি হলো তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কী অভিমত’; সে বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন।
আমাকে ইনশাআল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন’।অতঃপর তারা উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে* কাত করে শুইয়ে দিল । ( সূরা আস- সাফফাতঃ- ১০২-৩)
কোরবানির গুরুত্ব
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে।
নিশ্চয় আমি আপনাকে হাউজে কাউসার দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ ও কুরবানি আদায় করুন।
আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেন- হে আমার হাবিব আপনি বলুন যে, অবশ্যই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ, সব কিছুই মহান প্রতিপালকের জন্য। (সূরা আনআ’ম- ১৬২)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন- তারা কতক নির্দিষ্ট দিনে গৃহ পালিত চতুষ্পদ জন্তুর মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করে। (সুরা হজ্ব: আয়াত- ২৮)
আল্লাহর কাছে (কুরবানীর পশুর)) গোশত ও রক্ত পৌঁছে না বরং তোমাদের অন্তরের তাকওয়া পৌঁছে থাকে। (সূরা হজ্ব, আয়াত- ৩৭)
রাসুল সা. হাদিসে বলেন, হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, কুরবানির দিন পশু কুরবানির চাইতে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় আর কোন আমল, নেই। কেয়ামতের দিন জবেহ করা পশুকে তার শিং ও খুরসহ হাজির করা হবে। কুরবানির জন্তুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা খোলা মনে এবং সন্তুষ্টি চিত্তে কুরবানি কর। (মেশকাত শরীফ)
কুরবানির ফজিলত
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে। হজরত জায়দ ইবনে আকরাম বলেন, সাহাবায়ে কেরাম নবী করিম (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করেন, কুরবানি কী? নবী করিম (সা.) বলেন, ‘কুরবানি হলো তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নত।’এতে আমাদের সওয়াব কী? নবী করিম (সা.) বলেন, ‘কুরবানির পশুর প্রত্যেকটি পশমের বদলায় একটি করে সওয়াব রয়েছে। ভেড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ভেড়ার প্রত্যেকটি পশমের বদলায়ও একটি করে সওয়াব রয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ)
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ্জ- ৩৭)
ইতিহাসের প্রথম কুরবানী
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কুরবানি ছিল মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানি। সেখান থেকেই কুরবানির প্রচলন শুরু হয়। পবিত্র কুরআনে বিশদভাবে সে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আদমের দুই ছেলের কাহিনি আপনি তাদেরকে যথাযথভাবে শোনান। যখন তারা কুরবানি করেছিল, তাদের একজনের কুরবানি কবুল করা হলো এবং অন্যজনেরটা প্রত্যাখ্যান করা হলো। সে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। অন্যজন বলল, আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকিদের পক্ষ থেকেই কবুল করেন। (সূরা মায়িদা : ২৭)।
হজরত আদম ও হাওয়া (আ.)-এর মাধ্যমেই পৃথিবীতে বংশ বিস্তার আরম্ভ হয়। হাওয়া (আ.) প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র সন্তান ও একটি কন্যাসন্তান, এরূপ যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। তখন শরিয়তের বিধান ছিল, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই বোন। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম। কিন্তু পরবর্তী গর্ভের পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভে জন্মগ্রহণকারিণী কন্যা সহোদরা বোন নয়। তাদের মধ্যে পরস্পর বিবাহবন্ধন বৈধ।
ঘটনাক্রমে কাবিলের সহোদরা বোন ছিল পরমাসুন্দরী এবং হাবিলের সহজাত ছিল অপেক্ষাকৃত কম সুন্দরী। বিয়ের সময় হলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহজাত বোন কাবিলের ভাগে পড়ে। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রু হয়ে যায়। সে জিদ ধরে বলল, আমার সহজাত বোনকে আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। আদম (আ.) তার শরিয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন। কাবিল তার সিদ্ধান্তে আটল। সে তার বক্তব্য থেকে সরে আসতে নারাজ।
এতে উভয়ের মাঝে মতভেদ দেখা দেয়। এ মতভেদ নিরসন করার উদ্দেশ্যে হজরত আদম (আ.) বললেন, তোমরা উভয়েই আল্লাহর নামে কুরবানি পেশ কর। যার কুরবানি গৃহীত হবে, সে ওই কন্যাকে বিবাহ করতে পারবে। আদম (আ.) নিশ্চিত ছিলেন, যে সৎ পথে আছে, তার কুরবানিই গৃহীত হবে। তখন কুরবানি গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কুরবানিকে ভস্মীভূত করে ফেলত। যার কুরবানি ভস্ম করত না, তা প্রত্যাখ্যাত হিসাবে গণ্য হতো।
হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি লালন-পালন করত। তাই সে একটা উৎকৃষ্ট দুম্বা কুরবানি হিসাবে পেশ করল। আর কাবিল কৃষিকাজ করত। সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কুরবানির জন্য পেশ করল। নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগুন এসে হাবিলের কুরবানিটি জ্বালিয়ে দিল এবং কাবিলের কুরবানি যেমন ছিল, তেমনই পড়ে রইল। অকৃতকার্য হলো কাবিল। তার কুরবানি গৃহীত হয়নি হাবিলেরটা গৃহীত হয়েছে। কবুল হয়েছে।
নিয়ম মাফিক কাবিল তার সহোদরা বোনকে বিবাহ করতে পারবে না। ফলে তার দুঃখ ও ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। আত্মসংবরণ করতে না পেরে প্রকাশ্যে হাবিলকে হত্যার হুমকি দিল। বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব। হাবিল মার্জিত ও নীতিবাক্য উচ্চারণ করে সহানুভূতি প্রকাশ করে বলল, আল্লার নিয়ম তো এই, তিনি আল্লাহভীরু মুত্তাকিদের কর্মই গ্রহণ করেন। তুমি আল্লাহভীতি অবলম্বন করলে তোমার কুরবানিও গৃহীত হতো। এটাই ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম কুরবানি। (তাফসিরে ইবনে কাসির, সূরা মায়িদাহ, ২৭তম আয়াতের তাফসির দ্র.ব্য.)