ইসলাম কাকে বলে

শোভন ও ইমন দুই সহোদর। সম্প্রতি এশিয়া কাপ ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হয়। তারা দুজনে বসে খেলা দেখছিল। মাগরিবের নামাযের আযান হলে শোভন মসজিদে গেল। নামায শেষে শোভন ফিরে এসে ইমনকে নামাযের কথা বললে সে বলল, খেলা দেখা বাদ দিয়ে নামায কালাম পড়ে লাভ কী? শোভন ও ইমনের বন্ধু জুলহাস গত বছর এম.এ পাস করে একটি চাকরির জন্য আবেদন করে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাকে সে বলে, তাকে চাকরিটা দিলে তাকে সে দুই লক্ষ টাকা দিবে। সে চাকরিটা পেয়ে কথামতো কর্মকর্তাকে দুই লক্ষ টাকা প্রদান করে। বিষয়টি জেনে এলাকার ইমাম সাহেব তাকে বলেন, এভাবে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে চাকরি পাওয়া ইসলামের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং সারাজীবন এর ফল ভোগ করতে হবে।
ইসলাম কাকে বলে?
আল্লাহ তায়ালা ও রাসুল (স.)-এর আনুগত্য করাকে ইসলাম বলে।
ইসলামের পরিচয়
ওয়ালি উল্লাহ সিরাজ : ইসলাম আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ অনুগত হওয়া, আনুগত্য করা, আত্মসমর্পণ করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর অনুগত হওয়া, আনুগত্য করা ও তার নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা; বিনা দ্বিধায় তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এবং তার দেওয়া বিধান অনুসারে জীবনযাপন করা। আর যিনি ইসলামের বিধান অনুসারে জীবনযাপন করেন, তিনি হলেন মুসলিম বা মুসলমান। ইসলাম আল্লাহপাকের মনোনীত একমাত্র ‘দ্বীন’, যা একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত এ ব্যবস্থার আলোকে একজন মুসলমানকে জীবনযাপন করতে হয়। ইসলামে রয়েছে সুষ্ঠু সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থ ব্যবস্থা। আরো আছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা। মানব চরিত্রের উৎকর্ষসাধন, ন্যায়নীতি ও সুবিচারভিত্তিক শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণ গতিশীল সুন্দর সমাজ গঠন এবং সংরক্ষণে ইসলামের কোনো বিকল্প নেই, হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাপাক ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দ্বীন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯)। অন্য একটি আয়াতে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৮৫)।
হাদিস শরিফে ইসলামের একটি সংজ্ঞা ও পরিচিতি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলাম হলো, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল বলে সাক্ষ্য দেওয়া, সালাত আদায় করা, জাকাত প্রদান করা, রমজানের রোজা পালন করা এবং সামর্থ্য থাকলে বায়তুল্লাহ শরিফে গিয়ে হজ আদায় করা।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
বস্তুত ইসলামই সব নবী-রসুলের অভিন্ন ধর্ম। হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত আগমনকারী সব নবী-রসুলই মানুষকে ইসলামের দিকেই আহ্বান করেছেন এবং এরই ভিত্তিতে নিজ নিজ উম্মতকে গড়ে তুলেছেন।
হজরত ইব্রাহীমই (আ.) সর্বপ্রথম নিজ ধর্মের নাম ইসলাম এবং তার উম্মতকে ‘উম্মাতে মুসলিম’ বলে অভিহিত করেছেন। পবিত্র কোরআনে বিষয়টিকে আল্লাহপাক তুলে ধরেছেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে মুসলিম তথা তোমার অনুগত বানাও এবং আমাদের বংশধর হতেও এক
উম্মাতে মুসলিম অর্থাৎ তোমার এক অনুগত উম্মত বানাও।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৮)।
হজরত ইব্রাহীম (আ.) তার সন্তানদের প্রতি অসিয়ত করে বলেন, ‘তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৩২)।
মোটকথা, নবী-রসুলগণের প্রচারিত ধর্মে মৌলিক কোনো পার্থক্য ছিল না। কিন্তু প্রত্যেকের শরিয়ত ছিল ভিন্ন ভিন্ন। আল কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরিয়ত ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫:৪৮)।
ইসলামের ১০ বৈশিষ্ট্য
ইসলাম ধর্মের অসংখ্য বৈশিষ্ট্য থেকে নিম্নে ১০টি বিশেষ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো—
১. ইসলাম চূড়ান্ত জীবন বিধান : ধর্ম বা জীবন বিধান হিসেবে ইসলামই চূড়ান্ত। আল্লাহর কাছে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম ও মতবাদ মূল্যহীন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর কাছে একমাত্র দ্বিন (বা জীবন বিধান)।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বিন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে হবে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৮৫)
২. আসমানি ধর্ম : ইসলাম মানব রচিত বা মানুষের প্রবর্তিত কোনো দ্বিন নয়। এই দ্বিন আল্লাহর পক্ষ থেকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এভাবে আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রুহ তথা আমার নির্দেশ; তুমি তো জানতে না কিতাব কী এবং ঈমান কী! পক্ষান্তরে আমি তাকে করেছি আলো, যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করি; তুমি তো প্রদর্শন করো কেবল সরল পথ।’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ৫২)
৩. সংরক্ষিত দ্বিন : পূর্ববর্তী আসমানি ধর্মগুলো সংরক্ষিত ছিল না।
ফলে যুগে যুগে তাতে বহু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিকৃতি ঘটেছে। এমনকি বিংশ শতাব্দীতে এসেও তাতে বহু সংযোজন ও বিয়োজন হতে দেখা গেছে। কিন্তু আল্লাহ ইসলাম ধর্মকে সব ধরনের পরিবর্তন ও বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই তার সংরক্ষণকারী।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৯)
ইসলাম সংরক্ষিত অবস্থায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেভাবেই তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয় এবং সে মনগড়া কথাও বলে না। এটা তো ওহি, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে। তাঁকে শিক্ষা দান করে শক্তিশালী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন (ফেরেশতা জিবরাইল), সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়েছিল।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ২-৬)
৪. সর্বজনীন ও বৈশ্বিক ধর্ম : আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছেন এবং কোরআনে আল্লাহ মানবজাতির জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর বিবরণ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলো, হে মানুষ! আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রাসুল, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৫৮)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করলাম।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৮৯)
৫. পূর্ববর্তী ধর্মের সত্যায়নকারী : ইসলাম-পূর্ববর্তী আসমানি ধর্মের সত্যায়নকারী এবং ইসলামে পূর্ববর্তী আসমানি ধর্মের মৌলিক শিক্ষাগুলো বিদ্যমান। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা বলেছিল, হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শ্রবণ করেছি, যা অবতীর্ণ হয়েছে মুসার পরে, এটা পূর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে।’ (সুরা : আহকাফ, আয়াত : ৩০)
৬. ভারসাম্যপূর্ণ দ্বিন : ইসলাম মানুষের পার্থিব ও অপার্থিব জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেছে। ইসলাম যেমন পার্থিব জীবনের আয়োজনগুলো অস্বীকার করে না, তেমনি তাতে নিমজ্জিত থাকার অনুমতি দেয় না। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যা তোমাকে দিয়েছেন তা দ্বারা আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কোরো এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলো না।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৭৭)
৭. মানব প্রকৃতির অনুকূল ধর্ম : ইসলাম মানব প্রকৃতির অনুকূল ধর্ম। ইসলাম মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করে এবং মানব প্রকৃতির বিরোধী বা তার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে—এমন বিষয়গুলো ইসলামে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দ্বিনে প্রতিষ্ঠিত কোরো। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কোরো, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই সরল দ্বিন; কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ জানে না।’ (সুরা : রোম, আয়াত : ৩০)
৮. মধ্যপন্থী ধর্ম : ইসলাম মানুষকে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে বলে। কোনো বিষয়ে চরম শিথিলতা ও চরম কঠোরতা ইসলাম পছন্দ করে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি। যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসুল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৪৩)
৯. জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধর্ম : ইসলাম পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম, যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘ইকরা’ (পড়ো) বাক্যের মাধ্যমে। ইসলামে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়েছে। কোরআনের একাধিক আয়াত ও অসংখ্য হাদিসে মানুষকে জ্ঞানচর্চার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলো, যারা জানে এবং যারা জানে, তারা কি সমান? বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা : ঝুমার, আয়াত : ৯)
১০. নীতি-নৈতিকতার ধর্ম : ইসলাম আখলাক তথা উত্তম চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতার ধর্ম। রাসুলুল্লাহ (সা.) সচ্চরিত্রকে মানুষের ভালো-মন্দের মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আর কোরআনে মুমিনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনরা, যারা বিনয়-নম্র নিজেদের নামাজে, যারা অসার কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকে, যারা জাকাতদানে সক্রিয়, যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে, ...যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং যারা নিজেদের নামাজে যত্নবান থাকে।’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ১-৯)
আল্লাহ সবাইকে সত্য উপলব্ধি করার তাওফিক দিন। আমিন।