বাংলাদেশের উৎসব রচনা
-6773b7f2855d0.png)
Admin
December 31, 2024
530
বাংলাদেশের উৎসবসমূহ দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য প্রকাশ। বাংলা নববর্ষের বর্ষবরণ উৎসব, বৈসাবি, নবান্ন, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বইমেলা, ঈদ, দুর্গাপূজা—এসব উৎসব নানা রঙ ও বৈচিত্র্যে সজ্জিত। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে প্রতিটি উৎসবই দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। প্রতিটি উৎসবের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, তাৎপর্য ও আয়োজন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গভীরতাকে উপলব্ধি করা যায়। বাংলাদেশে পালিত এই উৎসবগুলো কেবল আনন্দ ও উদযাপনেরই নয়, বরং ঐতিহ্য, দেশপ্রেম এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতীক।
ভূমিকা:
উৎসব সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর মধ্যে নিহিত থাকে একটি জনপদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কিংবদন্তি এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস ও ভালো-মন্দ লাগার উপাদান। কোনো দেশ বা সমাজের উৎসব সম্পর্কে জানা থাকলে সেই দেশ বা সমাজের মানুষকেও অনেকখানি জানা যায়। কবির ভাষায়-
‘বাংলাদেশের উৎসবের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য,
আমাদের প্রগাঢ় স্বদেশপ্রেমেরই সৌন্দর্য।’
(নীল রোদ্দুরে জীবনঘড়ি- আতাউর রহমান)
উৎসব হতে পারে কোনো জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক, আবার হতে পারে জনপদ বা ভূখণ্ডকেন্দ্রিক। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের উৎসব প্রচলন রয়েছে। তবে অধিকাংশ উৎসবই কোনো না কোনো ঋতু বা মাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এসব উৎসব মানুষের মনে কেবল আনন্দেরই সঞ্চার করে না; বরং এর মধ্য দিয়ে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সামগ্রিক চিত্রটি ফুটে ওঠে। বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি উৎসব সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো। বাংলা নববর্ষের সূচনাকাল:
মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সালের প্রবর্তন করেন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বাংলা সাল গণনা শুরু হয়। ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ বা ‘পহেলা বৈশাখ’ হিসেবে ওই দিন সরকারি ছুটি থাকে।
বাংলা বর্ষবরণ:
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব বাংলা বর্ষবরণ। পুরোনো দিনের দুঃখ, ব্যথা, ক্লান্তি, গ্লানি ভুলে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার উৎসব এটি। এই উৎসব বাংলাদেশের সর্বত্র পালিত হয়। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষ এই উৎসব পালন করে। এ উপলক্ষে মেলা ও মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। উল্লেখ্য, ইউনেসকো বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
হালখাতা:
ব্যবসায়ীরা এই দিনে ‘হালখাতা’ নামে হিসাবের নতুন খাতা খোলেন এবং বকেয়া আদায় উপলক্ষে গ্রাহকদের নিমন্ত্রণ করে মিষ্টিমুখ করান। বৈশাখের প্রথম দিনটিতে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মজাদার খাবারের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক আড়ম্বরে উদযাপন করা হয় বাংলা নববর্ষ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কথায়-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের করা হয় শোভাযাত্রা। নতুন বছরের সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের করা হয় শোভাযাত্রা। নতুন বছরের সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বৈসাবি:
বাংলাদেশে তিনটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার উৎসব ‘বৈসাবি’। শব্দটি বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু এই তিন নামের আদ্যক্ষর নিয়ে গঠিত। বৈসু, সাংগ্রাই ও বিজু যথাক্রমে ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসব। সাধারণত বছরের শেষ দুই দিন (চৈত্র মাসের) এবং নতুন বছরের (বৈশাখ) প্রথম দিন বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বৈসাবি উদযাপিত হয়।
নবান্ন:
নবান্ন হলো নতুন ধানের উৎসব। হেমন্ত কালে ঘরে ঘরে নতুন ধান ওঠে। ওই সময়ে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। আত্মীয়-পরিজন ও প্রতিবেশীদের উপস্থিতিতে ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।
একুশে ফেব্রুয়ারি:
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিলকারীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। তাদের ওপর সরকারি নির্দেশে পুলিশ গুলি চালায়। এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে শহিদ হন। এই আত্মত্যাগ এবং দীর্ঘ সংগ্রামের ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয় এবং ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। শহিদদের স্মৃতিকে স্মরণ করতে ও শ্রদ্ধা জানাতে পরের বছর থেকেই দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে। খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ, শহিদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, আলোচনা সভা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে দিবসটি পালিত হয়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সেই প্রভাত ফেরির গানের সুরে সুরে আমরা আজও বলি-
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?’
শহিদদের আত্মদান ও পৃথিবীর সব মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোয় একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির এই আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেতে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস:
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ হিসেবে দিনটি পালিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে। সরকারি ও বেসরকারি নানান উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়। অফিসে, বাড়িতে, সড়কে, যানবাহনে সর্বত্র বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা শোভা পায়। এদিন জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ সারা দেশের স্মৃতিসৌধগুলোয় পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। একই সঙ্গে শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বাহিনীর কুচকাওয়াজ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপিত হয়।
বিজয় দিবস:
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় অর্জন করে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ কবিতার ভাষায়-
‘সাবাশ বাংলাদেশ! এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
বিজয় দিবস বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গৌরবের। তাই ডিসেম্বর এলেই সমগ্র দেশ লাল-সবুজে সেজে ওঠে। ১৬ ডিসেম্বর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ সারা দেশের স্মৃতিসৌধগুলোয় পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসব, ক্রীড়া অনুষ্ঠান ও বই মেলার আয়োজন করা হয়।
বইমেলা:
‘বই পড়িলে আলোকিত হই, না পড়িলে অন্ধকারে রই’ এ স্লোগানকে ধারণ করে বইমেলা বাংলাদেশের আরেকটি প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বইমেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বইমেলা- ফেব্রুয়ারিজুড়ে ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এই বইমেলা পরিণত হয় পাঠক ও লেখকের মিলনমেলায়। বইমেলায় অনেক লেখক তাদের নতুন বই যেমন প্রকাশ করেন, তেমনি আগে প্রকাশিত বইও মেলায় পাওয়া যায়। বইমেলা এখন আর কেবল বই কেনাবেচার মেলা নয়, এটি পরিণত হয়েছে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক উৎসবে।
ঈদ:
ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। ঈদ আসে আনন্দ আর মিলনের বার্তা নিয়ে। এই দিনে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেয়। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে সাড়ম্বরে ঈদ পালিত হয়। বছরে দুটি ঈদ। প্রথমে ঈদুল ফিতর এবং পরে ঈদুল আজহা মুসলমানদের জন্য আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। রমজান মাসের শেষে হিজরি শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ভাষায়-
‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ।’
জিলহজ মাসের দশম দিনে পালিত হয় ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি করা হয়। একে বলা হয় আত্মত্যাগের ঈদ। দুটি ঈদেই মুসলমানরা নতুন পোশাক পরে, ধনীরা গরিবদের দান করে। ঈদগাহে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হয়। নামাজের পর একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করে। বাড়িতে ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়। নিজে খেয়ে এবং অন্যকে খাইয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়।
দুর্গাপূজা:
হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। শরৎকালে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে সপ্তমীর আগের দিন ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর বোধন অনুষ্ঠান হয়। নবমীর পরদিন দশমীর উৎসবকে বলা হয় বিজয়া দশমী। বোধন থেকে বিসর্জনের দিনগুলো বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনকে আন্দোলিত করে। পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হয় পূজামণ্ডপ, থাকে প্রসাদের আয়োজন। বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় মেলা। দুর্গাপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হলেও অন্য ধর্মাবলম্বীরাও আনন্দ নিয়ে পূজামণ্ডপে ঘুরতে যায়। অষ্টমীর দিন আনন্দ আর জাঁকজমক থাকে বেশি। রাতে হয় আরতি। দশমীর দিন দেবী-বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা।
অন্যান্য উৎসব:
এ ছাড়া সারা বছরই বাংলাদেশে কোনো না কোনো উৎসব পালিত হয়। যেমন- রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, লালন উৎসব, মধুমেলা, মহররম, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, প্রবারণা পূর্ণিমা, ইস্টার সানডে ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বিভিন্ন উৎসব আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করে থাকে।